দিল্লিতে সহিংসতায় ৪২ জনের প্রাণহানি: সাহায্যের ১৩ হাজার ফোন পেয়েও নিষ্ক্রিয় ছিল পুলিশ

0
474
দিল্লিতে সহিংসতায় ৪২ জনের প্রাণহানি: সাহায্যের ১৩ হাজার ফোন পেয়েও নিষ্ক্রিয় ছিল পুলিশ

খবর৭১ঃ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) ঘিরে দিল্লির সহিংসতায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৪২ জনে দাঁড়িয়েছে। শুক্রবার সকাল থেকে কোনো কোনো এলাকায় ১৪৪ ধারা তুলে নেয়া হয়েছে। স্বাভাবিক হওয়ার পথে একটু একটু করে এগোচ্ছে রাজধানী দিল্লি।

তবে সিএএ ঘিরে দিল্লির পর উত্তর-পূর্বের রাজ্য মেঘালয় উত্তাল হয়ে ওঠেছে। শুক্রবার সেখানে সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। এদিকে, দায়িত্ব নেয়ার পর দিল্লির নতুন পুলিশ কমিশনার জানিয়েছেন, অভিযুক্তদের দ্রুত চিহ্নিত করা হবে? তাদের শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থাও করা হবে? দিল্লির সহিংসতায় এখন পর্যন্ত ছয় শতাধিক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপরদিকে, সহিংসতার সময় সাহায্যের জন্য ১৩ হাজারেরও বেশি ফোনকল পেলেও দিল্লি পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল বলে অভিযোগ ওঠেছে।

টানা ৬ দিন চলা তাণ্ডবের সময় গুলি, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়ার অভিযোগ পেয়েছিল পুলিশ। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি তারা। খবর আনন্দবাজার, এনডিটিভি, টাইমস অব ইন্ডিয়া, বিবিসি ও রয়টার্সের।

দিল্লিতে ২৩ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া হিন্দুত্ববাদী তাণ্ডবে নিহতের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) নিহতের সংখ্যা ছিল ২৭, বৃহস্পতিবার ৩৮-এ পৌঁছায়। শুক্রবার এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৪২-এ। হাসপাতাল সূত্র জানায়, ২১ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ আহতদের মধ্যে অনেকে এখনও ঝুঁকিমুক্ত নন। দৃষ্টিশক্তিও পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছেন অনেকে।

জানা গেছে, সহিংসতার প্রথম ৪ দিনে দিল্লি পুলিশের কাছে ১৩ হাজার ২০০টি ফোন যায়। তবে পুলিশ নীরব ছিল। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, পুলিশ ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার জন্যই সহিংসতা এমন চরম আকার ধারণ করে। ফোনে বারবার অভিযোগ করা সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ। স্থানীয়দের সেইসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতেই পুলিশ কন্ট্রোল রুমের কল লগ খতিয়ে দেখেছে সংবাদ মাধ্যম। এতে দেখা গেছে, ২৩ ফেব্রুয়ারি (রোববার) বিক্ষোভের প্রথম দিন সন্ধ্যায় ৭০০টি ফোন গেছে পুলিশের কাছে। সোমবার এক ধাক্কায় তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৫০০-এ। মঙ্গলবার ৭ হাজার ৫০০ ফোন পায় পুলিশ। বুধবার ১ হাজার ৫০০টি ফোন পায় পুলিশ। ২৪ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি শুধু যমুনা বিহার থেকেই ভজনপুরা থানায় ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার ফোন গেছে। ভজনপুরা থানার আট পাতার কল রেজিস্টার খতিয়ে দেখা গেছে, কোন নম্বর থেকে ফোন গেছে, কী অভিযোগ এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

রেজিস্টারের পাতায় আলাদা আলাদা কলাম থাকলেও শুধু কোথা থেকে ফোন এসেছিল, কী অভিযোগ তা-ই লেখা রয়েছে। এমনকি তাতে গুলিবর্ষণ এবং আগুন লাগানোর অভিযোগও লেখা রয়েছে। কিন্তু এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তার উল্লেখ নেই। অর্থাৎ অভিযোগ পেয়েও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশ।

যমুনা বিহারের বিজেপি কাউন্সিলর প্রমোদ গুপ্ত জানান, শুধু সাধারণ মানুষই নন, আমার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি আমার ফোনই ধরেনি। প্রমোদ গুপ্ত বলেন, ‘পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি। পুলিশ ব্যবস্থা নিলে পরিস্থিতি এতটা খারাপের দিকে মোড় নিত না।

একই অভিযোগ শিববিহারের ‘রাজধানী পাবলিক স্কুল’র মালিক ফয়জল ফারুখের। তিনি জানান, সোমবার স্কুলে হামলা চালানো হয়। সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-শিক্ষিকা বেরিয়ে গেলে বারবার পুলিশকে ফোন করি। ফোনে তারা আশ্বাস দিলেও স্কুল চত্বরে কোনো পুলিশ আসেনি।

মেঘালয়ে সংঘর্ষে একজন নিহত : সিএএবিরোধী আন্দোলনে উত্তর-পূর্বের রাজ্য মেঘালয়ে একজনের মৃত্যু হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ে কারফিউ জারি করা হয়েছে। ছয় জেলায় ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সঙ্গে অন্যদের দফায় দফায় সংঘর্ষে শিলংসহ একাধিক জায়গা উত্তাল হয়ে ওঠে। সংঘর্ষে পূর্ব খাসি হিলসে একজনের মৃত্যু হয়েছে। সমস্যা সমাধানে শুক্রবার বৈঠক বসেছিল ইচামতী এলাকায়।

সেখানেই সংঘর্ষ বাধে দুই দলের মধ্যে। এতে একজন নিহত হন। এরপর বিকাল থেকে শিলং এবং সংলগ্ন এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়। এর পাশাপাশি মেঘালয়ের পূর্ব জয়ন্তিয়া হিল, পশ্চিম জয়ন্তিয়া হিলস, রি ভোই, পশ্চিম খাসি হিলস, দক্ষিণ-পশ্চিম খাসি হিলস জেলায় মোবাইল ও ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ৪৮ ঘণ্টা সেখানে ইন্টারনেট ও মোবাইল পরিষেবা বন্ধ থাকবে।

বিজেপিকেই দুষছেন কলকাতার অভিনয় শিল্পীরা : দিল্লির পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে হিংসা, রক্তপাত বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন বহু বিশিষ্ট মানুষ। অনেকে পুরো ঘটনার জন্য সরাসরি দায়ী করেছেন বিজেপিকে। তাদের মধ্যে রয়েছেন কলকাতার অভিনয় শিল্পীরাও। দিল্লিতে যে বিদ্বেষের আগুন জ্বলছে, তার জন্য সরাসরি বিজেপিকে দায়ী করেছেন অভিনেতা কৌশিক সেন। হিংসা ও রক্তপাত বন্ধ করে শান্তির আহ্বান জানিয়েছেন অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় ও অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত।

কৌশিক সেনের অভিযোগ, দিল্লি বলে নয়, বিজেপি যখনই কোনো বড় অসুবিধায় পড়ে তখনই যে কোনো সীমা পার করতে পারে। তাদের জন্য হিংসাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করা একটা বড় অস্ত্র। তারা ফাঁদ পাতে আর দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেই ফাঁদে একটা অংশ পা দিয়ে ফেলে। পরিকল্পিতভাবে সহিংসতা ছড়ানো হয়েছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, বিজেপি নেতা কপিল মিশ্র প্রকাশ্যে উসকানিমূলক মন্তব্য করেছেন। অথচ তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। দিল্লির পর কলকাতাসহ দেশের অন্য জায়গাতেও ঝামেলা বাঁধানোর চেষ্টা হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কৌশিক সেন।

অভিনেতা শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় বলেন, যা হয়েছে বা হচ্ছে তা অত্যন্ত দুঃখজনক ও উদ্বেগজনক। অশান্ত কোনো দলকে দিয়ে অশান্তি করানো সোজা। তার চেয়ে আজকের দিনে দায়িত্ব নিয়ে শান্তি বজায় রাখা আরও কঠিন। তার মতে, মৃত্যুর কোনো রঙ হয় না। কে কোন বর্ণ বা ধর্মের তা দেখা উচিত নয়। আর পরিস্থিতি সামলানোর জন্য রাজনীতির গুরুত্ব অনেক। নেতা, মন্ত্রীদের দায়িত্বও অনেক। সেটা ভুলে গেলে চলবে না?

ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, মৃত্যু কোনো সময়ই কাম্য নয়। চারপাশের মানুষজন বড় অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে আজকাল। পরিস্থিতি তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা হোক সেটাই আশা করতে পারি।

সহিংসতায় নিখোঁজদের খোঁজে স্বজনরা : উত্তর-পূর্ব দিল্লিতে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার ৬ দিন পার হলেও অনেক পরিবার তাদের নিখোঁজ সদস্যের খোঁজ করছে। মুস্তাফাবাদে নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন- গাজিয়াবাদের এক কলেজ শিক্ষার্থী। যিনি পরীক্ষা দিতে বাসা থেকে বের হয়ে আর ফেরেননি। মানসি গুপ্তার স্বজনরা তার ছবি হোয়াটসঅ্যাপসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে সন্ধান চেয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি। ২০ বছরের ওই শিক্ষার্থীর কাকা বিপিন গোয়াল জানান, পরিস্থিতি এখনো উত্তেজনাপূর্ণ। দ্রুতই তারা পুলিশকে বিষয়টি অবহিত করেন। কিন্তু তারাও খুব বেশি কিছু করতে পারেনি। গোকুলপুরি পুলিশ স্টেশনে আমরা যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কারফিউয়ের জন্য যেতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত আমরা গাজিয়াবাদে যাই। ওইদিন থেকে বারবার মানসির ফোনে কল করা হচ্ছে কিন্তু তা বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।

মুস্তাফাবাদের ২৫ ফোটা রোডের বিক্রেতা হামজা গিয়াসুদ্দিন আনসারি (২৫) বুধবার থেকে নিখোঁজ। তার এক আত্মীয় আনসারি আরিফ বলেন, আমার শ্যালক ও আমি সন্ধ্যায় নামাজ পড়তে যাই। পরে এক বন্ধুর দোকানে গিয়ে বসি। কিছু কাজের জন্য আমি বাসায় চলে আসি। কিন্তু আনসারি আর আসেনি। আমরা গোকুলপুরি থানায় গিয়েছিলাম, তারা আমাদের কথা শুনতেই চায়নি। আল হিন্দ হাসপাতালের জরুরি সেবায় ফোন করেছি কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। অন্যসব হাসপাতালেও গেছি। কিন্তু তার কোনো খোঁজ পাইনি। আনসারির পরিবারের আরেক সদস্য পুলিশের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। তারা আনসারির ছবি ও বিস্তারিত তথ্য দিয়ে পোস্টার বানিয়ে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কারও কাছ থেকে কোনো খবর পাওয়া যায়নি।

নিহতদের মধ্যে ২৮ জনের পরিচয় প্রকাশ : দিল্লিতে সহিংসতায় নিহত ৪২ জনের মধ্যে ২৮ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। জিটিবি হাসপাতাল ও বার্তা সংস্থা পিটিআইয়ের তথ্যের বরাতে এ তালিকা প্রকাশ করেছে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম দ্য ওয়্যার। নিহতরা হলেন- বাবরপুরের বাসিন্দা মোবারক হোসেন (২৮), অটোরিকশাচালক শহীদ খান আলভি (২২), অটোরিকশাচালক ও কারদামপুরি এলাকার বাসিন্দা মুদাসছির খান, ভাঙারি ব্যাপারি নাজিম খান (৩৫), জাফরাবাদের ভনপুরা এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ ফুরকান (৩০), ব্রিজপুরি এলাকার মেহতাব (২২), দিল্লি পুলিশের একজন হেড কনস্টেবল রতন লাল, বাবুনগর এলাকার বাসিন্দা রাহুল সোলাঙ্কি, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর নিরাপত্তা সহকারী অঙ্কিত শর্মা (২৬), বিনোদ কুমার (৪৫), বির ভান সিং (৪৮), ইলেকট্রিশিয়ান আশফাক হোসেন (৩৪), মান্দোলির বাসিন্দা দীপক (৩৪), কবিরনগর এলাকার ইশাক খান (২৪), শান মোহাম্মদ (৩৪), মৌজপুর এলাকার প্রভেশ (৪৮), মুস্তাফাবাদের জাকির (২৪), দিলবার, ব্রিজপুরি এলাকার রাহুল ঠাকুর (২৩), আমান (১৭), মারুফ (৩২), সালমান, ফায়জান (২৪), অলোক তিওয়ারি (৩৪), ইরফান (২৫), বাব্বু (৩২), আকবরি (৮৫) এবং ভাঙারি ব্যাপারি আইয়ুব সাব্বির (৬০) ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here