নড়াইলে চাপাতি দিয়ে ৩-জনকে কুপিয়ে জখম: হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে

0
258

উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি: ১৩ বছরের শিশু রাবেয়া খাতুন হাসপাতালে বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তার ডান হাত ও ডান পায়ের রগ কেটে ফেলেছেন তারই এক পাষ- শিক্ষক। ওই বিছানার পাশেই যন্ত্রণায় ছটফট করছেন রাবেয়ার দাদি। তাকেও একইভাবে কুপিয়েছেন ওই শিক্ষক। একই হাসপাতালের আরেক বিছানায় গলা ও হাতের কাটা অংশ নিয়ে যন্ত্রণায় চিৎকার করছে সাত বছরের আরেক শিশু। সেও শিক্ষকের নির্মমতার শিকার। নড়াইলের সদর থানার সিঙ্গিয়া গ্রামে রাবেয়ার বাড়িতে গিয়ে তাদের তিনজনকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করেন তারই পাষ- শিক্ষক রাকিবুল ইসলাম মিঠু বিশ্বাস। প্রেম ও বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় রাবেয়া এবং তার পরিবারের সদস্যদের কুপিয়েছেন মিঠু। রাবেয়া খাতুন, তার দাদি জাহানারা বেগম ও পাশের বাড়ির শিশু হেনা এখন ভর্তি রয়েছে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল)। তাদের তিনজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক জামিল। জানা যায়, হামলার দিন পাষ- শিক্ষক মিঠু বিশ্বাস হাতে চাপাতি নিয়ে সন্ধ্যা সময় হাজির হন রাবেয়া খাতুনের বাড়িতে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই এলোপাতাড়ি কুপিয়ে রাবেয়ার ডান পা ও ডান হাতের রগ কেটে দেন। এই শিক্ষকের কাছ থেকে রক্ষা পাননি রাবেয়ার ঘরে থাকা সাত বছরের শিশু হেনা, তার হাতে ও গলায় চাপাতি দিয়ে কোপায় মিঠু। তাদের বাঁচাতে গেলে রাবেয়ার দাদি জাহানারা বেগমের হাতেও চাপাতির কোপ দেন ওই শিক্ষক। চাপাতির কোপে রাবেয়ার দাদির ডান হাতের কঞ্জি শরীর থেকে আলাদা হয়ে যায়। আর বাম হাতের কঞ্জিও চাপাতির কোপে ছিঁড়ে অনেকাংশে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ভয়ানক এই ঘটনা সম্পর্কে রাবেয়ার বাবা রবিউল ইসলাম জানান, মিঠু বিশ্বাস নামের ওই কোচিং সেন্টারের শিক্ষকের বাড়ি তাদের একই গ্রামে। তাই ছোট বেলা থেকেই দুই পরিবারের লোকজনের মধ্যে জানাশোনা ছিল। মিঠু বিশ্বাস স্থানীয় নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের স্নাতকের ছাত্র। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি ‘ফুল অ্যান্ড ফাইনাল’ কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করতেন। এলাকায় প্রাইভেট শিক্ষক হিসেবেও তার বেশ সুনাম আছে। রবিউল ইসলাম আরো জানান, রাবেয়াকে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করানোর পর মিঠু বিশ্বাসের কাছে প্রাইভেট পড়তে পাঠায় তার পরিবার। গত জানুয়ারিতে প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন মিঠু বিশ্বাস। ওই ব্যাচে রাবেয়ার সঙ্গে আরও অনেকই মিঠু বিশ্বাসের কাছে প্রাইভেট পড়ত। কিন্তু প্রাইভেট পড়া শুরু করার এক মাসের মধ্যেই রাবেয়াকে নানাভাবে কৌশলে প্রেমের প্রস্তাব দিতে শুরু করেন মিঠু। এর পর রাবেয়া বিষয়টি তার পরিবারের সদস্যদের জানায়। এমন ঘটনা জানার পর মিঠু বিশ্বাসের কাছে প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করে দেয় রাবেয়ার পরিবারের সদস্যরা। তবে এতে থেমে থাকেননি মিঠু বিশ্বাস। তিনি নানাভাবে রাবেয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা অব্যহত রাখেন। পঙ্গু হাসপাতালে রাবেয়ার স্বজনরা জানান, রাবেয়ার সঙ্গে নানা কৌশলে প্রমের সম্পর্ক গড়তে গিয়ে ব্যর্থ হন মিঠু বিশ্বাস। পরে তার পরিবারের সদস্যদের গত ২৫ ফেব্রুয়ারি রাবেয়াকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান।মিঠু। ওই প্রস্তাব সরাসরি নাকোচ করেনি রাবেয়ার পরিবার। গত মাসের শেষের দিকে দুই পরিবার একসঙ্গে বিয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য আলোচনায় বসেন। ওই আলোচনায় রাবেয়ার বাবা মিঠু বিশ্বাসের পরিবারের সদস্যদের জানান, তার মেয়ে রাবেয়ার বয়স মাত্র ১৩ বছর। সে মাত্র ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। তাই বিয়ের বয়স না হওয়া পর্যন্ত বিয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। একই সঙ্গে মিঠু বিশ্বাসও তার পড়াশোনা শেষ করে ভালো একটা চাকরি করুক। তখন বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। অর্থাৎ কৌশলে সেই দিনের আলোচনাতে রাবেয়ার পরিবারের সদস্যরা বিয়ে দেবে না বলে জানিয়েছিল। রাবেয়ার বড় চাচা মো. ইলিয়াস বিশ্বাস জানান, বিয়েতে তারা রাজি হাওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট করেননি। কিন্তু ওই আলোচনার ১০-১২ দিন পর মিঠু বিশ্বাস ও তার মা রাবেয়ার সঙ্গে বাগদান সম্পন্ন করতে একটি আংটি নিয়ে হাজির হন তাদের বাড়িতে। কিন্তু সেই দিন রাবেয়ার বাবা, চাচাসহ পরিবারের সাদস্যরা সবাই বিয়ে দেবেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন। এ কারণে ওই দিন আংটি নিয়ে ফিরে যান মিঠু ও তার মা। আর এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতেই মিঠু বিশ্বাস এমন ভয়ানক ঘটনা ঘটিয়েছে। হামলার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাবেয়া ও তার দাদি জাহানারা বেগম জানান, গত ১৫ মার্চ সন্ধ্যায় পাশের বাড়ির সাত বছরের শিশু হেনাকে নিয়ে ঘরে পড়াশোনা করছিল রাবেয়া। ওই সময় রাবেয়ার মা নানির বাড়িতে ছিলেন। আর দাদি জাহানারা বাড়িতে রান্না করছিলেন। এ সময় হঠাৎ মিঠু বিশ্বাস তাদের বাড়িতে প্রবেশ করেন। তখন মিঠু বিশ্বাসের হাতে কিছু একটা ছিল, যা তিনি পেছনে লুকিয়ে রেখেছিলেন। বাড়িতে প্রবেশের পর রাবেয়ার দাদি মিঠু বিশ্বাসকে জিজ্ঞেস করেন, কেন এসেছ, তোমার হাতে কী? উত্তরে মিঠু বিশ্বাস বলেন, ‘দাদি, তোমার নাতনির জন্য গিফট এনেছি।’ রাবেয়ার দাদি তখন মিঠুকে বলেন, ‘তুমি চলে যাও, আমার নাতনির কোনো গিফট লাগবে না।’ কথা বলার একপর্যায়ে দুজনের মধ্যে তর্ক শুরু হয়। এ সময় রাবেয়ার দাদি মিঠু বিশ্বাসের হাতে একটি চাপাতি দেখতে পেয়ে চিৎকার দেন। তখন মিঠু বিশ্বাস দৌঁড়ে রাবেয়ার ঘরে প্রবেশ করেন। একপর্যায়ে তিনি রাবেয়াকে চাপাতি দিয়ে কোপাতে শুরু করেন। আর রাবেয়ার ঘরে থাকা সাত বছরের শিশু হেনাকেও চাপাতির আঘাত করেন। রাবেয়া দাদি জাহানারা বেগম বলেন, ‘আমি ঘরে যায়া দেখি, দুজন পইড়া আছে মাটিতে। আমি তখন মিঠুকে বলি, আমার সোনারে মাইরো না। বলে আমি তার দিকে এগিয়ে যাই, তখন মিঠু আমার ডান হাতে কোপ দেয়। এর পর আমার বাম হাতে কোপ দেয়। তারপর আর আমার কিছু মনে নেই।’ রাবেয়ার বড় চাচা মো. ইলিয়াস বিশ্বাস বলেন, ‘এই ঘটনার সময় আমি বাজারে দোকানে ছিলাম। আমার স্ত্রী, আমাকে ফোন করে বলে, জলদি বাসায় এসো। আমি বাসায় গিয়ে দেখি, তিনজন রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। তখন আমি প্রথমে অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করে তাদের হাসপাতালে নিয়ে আসি।’ ইলিয়াস বিশ্বাস আরো বলেন, ‘পরে আশেপাশের বাড়ির মানুষের কাছে জানতে পারি, আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় একটি মাইক্রোবাস দাঁড়িয়ে ছিল। মিঠু বিশ্বাস আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নাকি সেই মাইক্রোবাসে দৌঁড়ে উঠে পালিয়ে গেছে। তাই এটা স্পষ্ট যে, মিঠু পরিকল্পনা করেই আমাদের বাড়িতে এসে সবাইকে এভাবে কুপিয়েছে।’ নারকীয় এই ঘটনার পর মিঠু বিশ্বাস এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। ওই দিন রাতেই নড়াইল সদর থানায় একটি মামলা দায়ের করে রাবেয়ার দাদা আলেক বিশ্বাস। মামলায় মিঠু বিশ্বাসসহ পাঁচজনকে আসামি করা হয়। এই বিষয়ে নড়াইলের পুলিশ সুপার পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন পি পি এম (বার),নড়াইল জেলা অনলাইন মিডিয়া ক্লাবের সভাপতি উজ্জ্বল রায়কে বলেন, ‘মামলার পরে আমরা মিঠু বিশ্বাসের বড় ভাই, যিনি মামলার দুই নাম্বার আসামি-তাকে গ্রেপ্তার করি। এর পরে আজ মিঠু বিশ্বাসসহ বাকি তিন আসামি আদালতে আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু আদালত তাদের জামিন নামঞ্জুর করে চারজনকেই কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।’ পুলিশ জানায়, ওই মামলায় বর্তমানে কারাগারে থাকা চার আসামি হলেন, মিঠু বিশ্বাস, উজ্জল, ফরিদ, সাজ্জাদ। তারা সবাই আপন ভাই। আর মামলার অপর আসামি ইরান এখনো পলাতক রয়েছেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলে মিঠু বিশ্বাসের বড় ভাই উজ্জলের স্ত্রী রোকসানা বলেন, ‘ঘটনা কী বলবো ভাই, ওই মেয়ের সাথে মিঠুর প্রেম-ভালোবাসা ছিল। মেয়েকে মিঠু সোনা-দানা, টাকা-পয়সা সব দিছে। মেয়ের মায়েও বিয়ে দিতে চাইয়া সব কিছু নিছে। সোনা-দানা সব নিছে, এখন বিয়ে দেয় না। তাই মিঠুর মাথা খারাপ হইছে। সে তাদের বাড়িতে গিয়া হাত-পা কাটছে।
খবর৭১/ইঃ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here