‘৩০ সেকেন্ডের হেরফেরে আমরা লাশ হয়ে যেতাম’

0
291

খবর ৭১ঃ তিন টেস্ট সিরিজের শেষ টেস্ট বাতিল হলে দেশে ফেরে বাংলাদেশ দল। গত শনিবার দেশে ফেরেন তামিমরা। শুক্রবার ক্রাইস্টচার্চের হামলা থেকে তারা অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন। ক্রিকইনফোকে ঘটনাটির বর্ণনা দিয়েছেন বাংলাদেশ দলের ওপেনার তামিম ইকবাল। তার জবানিতে উঠে এসেছে সে মুহূর্তের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির কথা। মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার সময় আশপাশের অবস্থা ও দলের সদস্যদের মনে এর কী প্রভাব পড়েছে, তা উঠে এসেছে। তামিম বলেন, মাত্র দু-তিন মিনিটের মধ্যে কীভাবে পরিস্থিতি বদলে গেল। সাধারণত জুমার খুতবার সময় মুশফিক ও রিয়াদ ভাই উপস্থিত থাকতে চান। আমরা এ কারণে আগেভাগে জুমার নামাজে যেতে চেয়েছি। বাস ছাড়ার কথা ছিল দুপুর দেড়টায়। রিয়াদ ভাই সংবাদ সম্মেলনে যান, সেখানে একটু দেরি হয়। সংবাদ সম্মেলন শেষে ড্রেসিংরুমে আসেন। আমরা ফুটবল খেলেছিলাম। তাইজুল হারতে চায় না। সবাই ওকে হারাতে চাইছিল। তাইজুল আর মুশফিক খেলছিল। এ সময় কয়েক মিনিট দেরি হয়। এ ছোটখাটো বিষয়গুলোই শেষ পর্যন্ত আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। আমরা বাসে উঠি। আমাদের পরিকল্পনা ছিল নামাজ শেষে হোটেলে ফিরে আসব। এ কারণে শ্রী (ভিডিও বিশ্লেষক শ্রীনিবাস) ও সৌম্য আমাদের সঙ্গে যায়। অনুশীলনটি অবশ্য ছিল ঐচ্ছিক। যারা করবে না, হোটেলে থাকবে। যারা করতে চায়, মাঠে আসবে। আমি সব সময় বাঁ দিকের ছয় নম্বর আসনে (বাসে) বসি। মসজিদের কাছাকাছি গেলে আমার ডান পাশের সবাই জানালা দিয়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করে। আমি দেখলাম, মেঝেতে একটা দেহ পড়ে আছে। স্বভাবতই ভেবেছিলাম মাতাল অথবা অজ্ঞান। বাস এগিয়ে গিয়ে মসজিদের কাছাকাছি দাঁড়াল। কিন্তু সবার মনোযোগ ছিল মেঝেতে পড়ে থাকা দেহটি ঘিরে। এমন সময় আরেকটি লোকের দিকে চোখ গেল। দেখলাম রক্তমাখা শরীর, ধীরে ধীরে পড়ে যাচ্ছে। সে মুহূর্তে ভয়টা দানা বেঁধে উঠতে শুরু করে। মসজিদের কাছাকাছি একটি গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল আমাদের বাস। দেখলাম বাসচালক এক নারীর সঙ্গে কথা বলছেন। ওই নারী সে সময় কাঁপছিলেন ও কাঁদছিলেন। তিনি বলছিলেনÑ গোলাগুলি হচ্ছে, ওদিকে যেও না, ওখানে যেও না। আমাদের বাসচালক বললেন, ওরা (খেলোয়াড়) মসজিদে যাচ্ছে। ওই নারী জবাবে বলেন, না না মসজিদে যেও না। মসজিদে গোলাগুলি হচ্ছে। এর পর তিনি আবার কাঁদতে শুরু করলেন। সবাই তার কথা শোনে ও দেখে। ভয়টা আরও বাড়ল। আমরা তখন মসজিদ থেকে মাত্র ২০ গজ দূরে। বাস থেকে নেমে মসজিদে ঢুকব, দেখলাম মসজিদের আশপাশে বেশকিছু রক্তমাখা শরীর পড়ে আছে। যখন আরও লাশ দেখলাম, সে মুহূর্তে কী করা উচিত বুঝতে পারছিলাম না। ভয়ে অনেকেই মাথার টুপি খুলে ফেলল। ততক্ষণে বুঝে গেছি কিছু একটা ঘটছে। আমাদের যারা পাঞ্জাবি পরে ছিল, ওপরে জ্যাকেট পরে নিল। এ ছাড়া আর কী করার আছে? এর পর আমরা বাসের মেঝেতে শুয়ে পড়ি। এভাবে সাত-আট মিনিট কাটল। ঠিক কী ঘটেছে, তা বুঝতে না পারলেও সহিংস কিছু যে ঘটছে, তা আঁচ করতে পারি। ভীষণ ভয় পেতে শুরু করে। দেখুন, ঠিকমতো কথা বলতে পারছি না। আমরা বাসচালককে বললাম, এখান থেকে বের করুন। কিছু একটা করুন। কিন্তু তিনি অনড়। সবাই চিৎকার করে তাকে বললাম। আমিও চিৎকার করেছি। ওই ছয়-সাত মিনিট কোনো পুলিশ ছিল না। হঠাৎ পুলিশ এলো। বিশেষ বাহিনী যেভাবে ঝড়ের বেগে মসজিদে ঢুকল, আমরা ভাষাহীন হয়ে গেলাম। শরীরটা হিম হয়ে আসছিল। রক্তমাখা শরীর নিয়ে আরও অনেকে বের হতে শুরু করে মসজিদ থেকে। তখন আর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। চিৎকার করতে শুরু করিÑ ‘আমাদের যেতে দাও, যেতে দাও।’ কেউ একজন বলল, ‘বাসে থাকলে বিপদে পড়ব।’ আমারও তা-ই মনে হলো। বাস থেকে বের হতে পারলে পালানোর সুযোগ পাব। বাসে আমরা সহজ লক্ষ্যবস্তু। কিন্তু যাব কোথায়? দুটি দরজাই বন্ধ। ঠিক সেই মুহূর্তে বাসচালক কেন জানি ১০ মিটারের মতো বাসটি এগিয়ে নেন। আমরা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছি। সবাই জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছে। মাঝের দরজায় ধাক্কা ও লাথি মারছি। সে মুহূর্তে বাসচালক দরজা খুললেন। ‘বাসটা তিনি (চালক) যে সময় সামনে নিচ্ছেন, তখন আপনাকে (প্রতিবেদক) ফোন করেছিলাম। আপনি ভেবেছিলেন মজা করছি। কিন্তু আমি কতটা সিরিয়াস, তা বলা কিংবা বোঝানোর মতো অবস্থায় ছিলাম না। প্রায় আট মিনিট পর বাস থেকে শেষ পর্যন্ত নামলাম। সবাই বলছিল, পার্ক দিয়ে দৌড় দিই। কেউ বলল, পার্কে সহজ লক্ষ্যে পরিণত হব। বন্দুকধারী যদি আমাদের দেখে গুলি করতে শুরু করে? আমার কাছে যেটা ভীতিকর লাগছিল, পুলিশ আমাদের দৌড়াতে দেখে কী ভাববে? এর মধ্যে দেখলাম আপনারা তিনজন (প্রতিবেদক মোহাম্মদ ইসাম, উৎপল শুভ্র ও মাজহারউদ্দিন) আসছেন। তখন আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু কাল রাতে বুঝলাম, কত বড় ঝুঁকি নিয়েছিলেন। অনেক কম মানুষই এমন ঝুঁকি নেয়। ওই রকম পরিস্থিতিতে কাছের মানুষও এমন ঝুঁকি নিত না। আসলে আপনাদের দেখে কিছুটা শান্ত হই এবং হাঁটতে শুরু করি। কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার পর সবাই মাঠের দিকে দিই দৌড়। জানেন, মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। শরীর ঠা-া হয়ে আসছিল। এটা এমন কিছু, যা সারাজীবন কখনো ভোলার মতো নয়। দলের সবারই এই এক কথা। ভালো দিক হচ্ছে সবার মুখে কিছুটা হাসি ফিরেছে; কিন্তু ভেতরে-ভেতরে বিধ্বস্ত। আমরা হোটেলে ফিরে সোজা রিয়াদ ভাইয়ের রুমে চলে যাই। বন্দুকধারীর ভিডিও দেখি। খেলোয়াড়রা কাঁদতে শুরু করে। ড্রেসিংরুমে সবাই কেঁদেছি। একটা কথা নিশ্চিত করে বলতে পারি, এ ঘটনা ভুলতে অনেক সময় লাগবে। পরিবারের সাহায্য লাগবে। লাগতে পারে কাউন্সেলিং। চোখ বুজলেই দৃশ্যগুলো ভেসে ওঠে। ওই রাতে বেশিরভাগ ক্রিকেটার একসঙ্গে ঘুমিয়েছে। আমি ঘুমিয়েছি মিরাজ ও সোহেল ভাইয়ের সঙ্গে। স্বপ্নে দেখেছি, বাইকে করে ওরা গুলি করছে। বিমানবন্দরে আসার পথে আমরা পরস্পর আলাপ করছিলাম। একটু এদিক-সেদিক হলেই আমরা নয়, লাশগুলো ঘরে ফিরত। মাত্র ত্রিশ সেকেন্ডের ব্যাপার।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here