১০ ডিসেম্বর নড়াইল মুক্ত দিবস!

0
307

উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি: ডিসেম্বর নড়াইল মুক্ত দিবস। রাত পোহালেই ১৯৭১ সালের এ দিনে নড়াইলের দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্তদিয়ে পাক হানাদার শকুনি বাহিনীদের সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করে নড়াইলকে মুক্ত করে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় ভাষণে স্বাধীনতার যে আহ্বান ছিল নড়াইলের মুক্তিপাগল জনতা তা থেকে পিছপা হয়নি। বিস্তারিত আমাদের নড়াইল জেলা প্রতিনিধি উজ্জ্বল রায়ের রিপোর্টে, ওই সময় নড়াইলের এসডিও’র বাসভবনকে স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের সদর দপ্তর করা হয়েছিল। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন নড়াইলের এসডিও কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, এম,এন,এ মরহুম অ্যাডভোকেট খন্দকার আব্দুল হাফিজ, আওয়ামীলীগ এমপি মরহুম এখলাছ উদ্দিন, বিশ্বাস মতিয়ার রহমান লোহাগড়া হাইস্কুলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও নড়াইলের সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বিশাল বাহিনী গঠন করে যশোর অভিমুখে পাঠিয়ে দেন। ৬ এপ্রিল সকালে পাক হানাদার বাহিনী দুটি জেট বিমান হতে নড়াইল শহরের ওপর ব্যাপকভাবে মেশিনগানের গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে প্রচুর ক্ষতি সাধন করলে নড়াইল শহর জনমানব শূন্য হয়ে পড়ে। ১৩ এপ্রিল হানাদার বাহিনীর একটি দল নড়াইল শহরের চৌরাস্তায় রেস্টুরেন্ট মালিক মন্টুকে গুলি করে আহত করে এবং হরিপদ সরদার, ভাটিয়া গ্রামের কালু বোস, সরসপুর গ্রামের প্রফুল্য মিত্রকে ধরে নিয়ে দাইতলা পুলের কাছে গুলি করে ফেলে রেখে চলে যায়। এদিকে ক্যাপ্টেন দোহার উদ্যোগে লোহাগড়ার ইতনা ও আড়িয়ারায় মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শিবির খোলার কারণে মধুমতি-নবগঙ্গা নদীর তীরবর্তী অ লের ভাটিয়াপাড়াস্থ হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প থেকে তাদের দোসর আলবদও রাজাকারদের সহযোগিতায় গানবোট যোগে পাকিস্থানী বাহিনী ইতনা গ্রামে ঢুকে নৃশংস অভিযান চালিয়ে ওই গ্রামের ১৯ জন নারী-পুরুষকে হত্যা করে। নির্বিচারে হত্যার পাশাপাশি বাড়ি-ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয় তারা এবং ব্যাপক লুটতরাজ করে। মুক্তিযুদ্ধের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুক্তিকামী হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে নড়াইলে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্ত ঘাঁটি গড়ে ওঠে। বিভিন্ন অ লে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের চলে তুমুল যুদ্ধ। শুধুমাত্র নড়াইল চিত্রা নদীর পাড়ে (প্রধান ডাকঘরের পার্শে) ৩ হাজারেরও অধিক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে পাকিস্তানী মিলিটারি বাহিনী ও তাদের দোসর আলবদর রাজাকাররা। এছাড়া নড়াইল সদর উপজেলার তুলারামপুর গ্রামের তরফদার পরিবারের স্কুল শিক্ষক আতিয়ার রহমান তরফদার, আব্দুস সালাম তরফদার, রফিউদ্দিন তরফদার, মাহতাব তরফদার ও আলতাব তরফদার এবং মোকাম মোল্যা, কাইজার মোল্যা ও মকবুল হোসেন সিকদারকে ধরে এনে নড়াইল শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভেতরে গণকবর দেয় পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা। দেশ হানাদার মুক্ত করার এক দূর্জয় আকাংখা নিয়ে সদর থানার মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে উজির আলী খান, লোহাগড়া থানায় মোক্তার আলী, ও কালিয়া থানায় ওমর আলীকে এবং মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে সদর থানায় শরীফ হুমায়ুন কবীর, লোহাগড়া থানায় শরীফ খসরুজ্জামান, ও কালিয়া থানায় আব্দুল মজিদ সরদারকে নিযুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইলে প্রবেশ করেন। অক্টোবর মাস হতে জেলার প্রত্যন্ত অ লের মুক্তিপাগল মানুষের মনে এক বিশ্বাস জন্মাতে থাকে যে হানাদার বাহিনী বা তাদের দোসররা আর বেশীদিন টিকতে পারবে না। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকেই নবগঙ্গা নদীর উত্তর ও পূর্বা াল হানাদার মুক্ত হয়ে যায়। লোহাগড়া থানা পাক হানাদার বাহিনীর ঘাটিকে ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডারগণ আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলে তারা আত্মসমর্পণ না করায় ৮ ডিসেম্বর প্রয়াত শরীফ খসরুজ্জামান, দবির উদ্দিন, ইউনুস আহমেদ, লুৎফর মাস্টার, আলী মিয়া, লুৎফর বিশ্বাসসহ অনেক গ্রুপ একত্রিত হয়ে সম্মিলিত ভাবে তিন দিক থেকে লোহাগড়া থানা আক্রমন করলে প্রচন্ড যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পন করে। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইলে হানাদার বাহিনীর ঘাটির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ৭ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী এস এম ফজলুর রহমান জিন্নাহর নেতৃত্বে নড়াইল সরকারী ভিক্টোরিয়া কলেজের দক্ষিণে মাছিমদিয়া গ্রামে সমবেত হয়ে পুলিশ-রাজাকারদের উপর অতর্কিত হামলা চালালে এ যুদ্ধে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা লোহাগড়ার জয়পুরের মিজানুর রহমান হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন। মিজানুর রহমানের মৃতদেহ হানাদার বাহিনীর দোসররা হাত-পা বেঁধে বাঁশে ঝুলিয়ে নড়াইল শহর প্রদক্ষিণ করে কৃতিত্ব দেখায় এবং ছবি তোলে। এ ঘটনার পর ৯ ডিসেম্বর বিজয়ের তীব্র আকাংখা নিয়ে কমান্ডার ফজলুর রহমান জিন্নাহ, আমির হোসেন, উজির আলী, শরীফ হুমায়ুন কবীর, আব্দুল হাই বিশ্বাসের নেতৃত্বে বর্তমান নড়াইল সরকারী ভিক্টোরিয়া কলেজের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ চালালে পাল্টা আক্রমণে মো. নজির হোসেন মোল্যার নেতৃত্বাধীন বাগডাঙ্গা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান শহীদ হন। ওই দিনই শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাংলোতে অবস্থানরত ৪০ জন পাক মিলিটারিকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলে তারা অস্বীকৃতি জানান। এসময় মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা চতুর্দিক থেকে প্রচন্ড গোলাবর্ষণ শুরু করলে পাক মিলিটারিরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এখানে একজন পাক মিলিটারি নিহত হয় এবং অন্যদের জেল হাজতে পাঠানো হয়। শীতের রাতে প্রবল শীতকে উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধারা সারা রাত শহরে বিজয় উল্ল¬াস করতে থাকে ও জয় বাংলা স্লোগানে স্লোগানে শহর প্রকম্পিত করে তোলে এবং ১০ ডিসেম্বর দুপুর ১টা ১৫ মিনিটে নড়াইলকে পাক হানাদার মুক্ত ঘোষণা করে। মুক্তিযুদ্ধে নড়াইলে ৫ জন খেতাবপ্রাপ্ত হন। তাঁরা হলেন- বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ, বীর উত্তম মুজিবুর রহমান, বীর বিক্রম আফজাল হোসেন, বীর প্রতীক খোরশেদ আলম ও বীর প্রতীক মতিয়ার রহমান। পরে ১৪ ডিসেম্বর এ সেক্টরের মেজর মঞ্জুর নড়াইলে আসেন এবং মুক্তি পাগল হাজারো জনতার উপস্থিতিতে ডাকবাংলো প্রাঙ্গণে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এদিকে নড়াইল মুক্ত দিবস উপলক্ষে জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও জেলা প্রশাসন আয়োজিত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মু্িক্তযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভ, বধ্যভূমি ও গণকবরে শ্রদ্ধাঞ্জলি ও দোয়া অনুষ্ঠান, র‌্যালি এবং আলোচনা সভা।
নড়াইলের কালিয়া মুক্ত দিবস ১০ ডিসেম্বও ১০ ডিসেম্বর নড়াইলের কালিয়া মুক্ত দিবস। ১৯৭১ এর এই দিনে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদারদের সঙ্গে সম্মূখ যুদ্ধের মাধ্যমে কালিয়াকে হানাদার মুক্ত হয়েছিল। দিবসটি পালন উপলক্ষে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা নানা কর্মসূচী পালন করা হয়। বিস্তারিত আমাদের নড়াইল জেলা প্রতিনিধি উজ্জ্বল রায়ের রিপোর্টে, জানা যায়,৭১’এর ৯ ডিসেম্বর ভোরে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইলের কালিয়া সদরে থাকা পাক হানাদারদের ঘাটিতে হামলা চালালে শুরু হয় সম্মূখ যুদ্ধ। প্রায় ২৪ ঘন্টা যুদ্ধ চলার পর ১০ ডিসেম্বর সকালে হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পনে বাধ্য হয়। ওই যুদ্ধে, আবুবকর, আকমান হোসেন ও সাদেকুর রহমান শহীদ হন। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আটক হয় প্রায় শতাধিক হানাদার ও রাজাকার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here