সড়ক দূর্ঘটনায় প্রতি দেড় ঘণ্টায় ১ জনের প্রাণহানি

0
445

খবর৭১ঃ আল্লাহ আমি কেন ওদের কথায় মোটরসাইকেলে উঠেছিলাম রে! এই ছিল আমার কপালে, আমার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে গেলো রে!” রাসেল আহম্মেদ গত ২৯ মার্চ খুলনার দৌলতপুরে মোটরবাইক দূর্ঘটনার শিকার হয়ে পায়ের ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে এভাবেই আর্তনাদ করছিলেন পঙ্গু হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার সিডি ওয়ার্ডে।

কিভাবে দুর্ঘটনা ঘটেছে জানতে চাইলে রাসেলের বাবা ঈশারা দিয়ে একটু দূরে আসতে বলেন। খানিক দূরে ডেকে নিয়ে জানালেন ভয়ঙ্কর সেই দুর্ঘটনার বিবরণ। ছেলে রাসেলসহ মোটরবাইকে তার যে দুই সহপাঠী ছিল তারা কেউই বেঁচে নেই, বেঁচে আছেন শুধু রাসেল। তা-ও অর্ধমৃত হয়ে। দুই হাত-পা দুমড়েমুচড়ে গিয়েছে তার। পাকা সড়কের আচড়ে উঠে গিয়েছে অর্ধেক শরীরের চামড়া। রাসেলের দুই বন্ধু যে মারা গিয়েছে সেটা এখনও জানেন না রাসেল।

শুধু রাসেলের সহপাঠীরাই নয়, প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সড়কের মৃত্যুফাঁদ এভাবেই কেড়ে নিচ্ছে অগণিত বন্ধু-স্বজন ও সাধারণ মানুষের প্রাণ। এসব সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে আছে- বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, বিপদজনক ওভারটেকিং, সড়ক-মহাসড়ক ও রাস্তা-ঘাটের নির্মাণ ক্রটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চলন্ত অবস্থায় মোবাইল বা হেড ফোন ব্যবহার, মাদক সেবন করে যানবাহন চালানো, মহাসড়ক ও রেলক্রসিংয়ে ফিডার রোডের যানবাহন উঠে পড়া, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা, যানবাহনে অতি পণ্য বা যাত্রী বহন এবং সড়কে ছোট যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, বাংলাদেশে সড়কে প্রতি দেড় ঘণ্টায় একজনের প্রাণহানি হচ্ছে।

সংঠগনটির তথ্যমতে, ২০১৮ সালের জানুয়ারি-ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জনের মৃত্যু হয়েছে।

সংগঠনটি আরও বলেছে, ২০১৮ সালে এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন আরও অন্তত ১৫ হাজার ৪৬৬ জন। সমিতির বার্ষিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালে দেশে সড়ক দূর্ঘটনা বাড়লেও হতাহতের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে।

তাদের আগের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ৪ হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৩৯৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল, আহত হয়েছিলেন ১৬ হাজার ১৯৩ জন।

এবারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে রেলপথে ৩৭০টি দুর্ঘটনায় ৩৯৪ জন নিহত ও ২৪৮ জন আহত হয়েছেন। আর নৌপথে ১৫০টি দুর্ঘটনায় ১২৬ জন নিহত ও ২৩৪ জন আহত হয়েছেন। নিখোঁজ রয়েছেন ৩৮৭ জন।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দূর্ঘটনায় পড়েছে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান। এ ধরনের বাহনের দূর্ঘটনায় পড়ার হার মোট দুর্ঘটনার ২৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ, মোটরসাইকেল ২৫ দশমিক ৩০ শতাংশ, বাস ১৮ দশমিক ৯২, অটোরিকশা ৯ দশমিক ৬১, নছিমন-করিমন ৫ দশমিক ৮০ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সড়কে প্রাণহানি কমিয়ে শৃঙ্খলা রক্ষায় চালকদের সচেতনতা ও নিবিড় প্রশিক্ষণ জোরদার করা জরুরি।

এদিকে অলাভজনক স্বেচ্ছাসেবী-সামাজিক সংগঠন ‘সেভ দ্য রোড’ এর তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে রেলপথে ২১০টি দুর্ঘটনায় ২২৪ নিহত হন এবং ৪৪৮ জন আহত হন। অপরদিকে নৌ-পথে ৮৭ টি দুর্ঘটনায় ৯৬ নিহত এবং ৩৩৪ জন আহত হন; আকাশ পথে ৫টি দূর্ঘটনায় ৫৫ জন নিহত এবং ৩২ জন আহত হন। সড়ক, রেল, নৌ এবং আকাশপথে সম্মিলিতভাবে ৫ হাজার ২৬ টি দুর্ঘটনায় ৫ হাজার ১১ জন নিহত এবং ১০ হাজার ৭৫৫ জন আহত হয়েছেন।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান নিটোর (পঙ্গু) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সড়ক দূর্ঘটনার শিকার হয়ে সেখানে ভর্তি হয়েছেন ১ লক্ষ ৭৯ হাজার ৮১০ জন, এদের মধ্যে গুরুতর আহত অবস্থায় অপারেশন করতে হয়েছে ১৭ হাজার ২৫৭ জন রোগীকে এবং সামান্য কাটাছেড়াজনিত সমস্যার কারণে অপারেশন করতে হয়েছে ১৫ হাজার ৪৫৮ জন রোগীকে।

অপরদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, গেল বছর সারা বিশ্বে সড়ক দূর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন সাড়ে ১৩ লক্ষ মানুষ।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলার জন্য সিগন্যাল ব্যবস্থা জোরদারের কোনও বিকল্প নেই। পাশাপাশি দূর্ঘটনা কমাতে দ্রুতগতির অবকাঠামোতে সমগতির গাড়ি চলাচল নিশ্চিত করতে হাইওয়ে পুলিশের কঠোর নজরদারি প্রয়োজন।

গত ২ মেয়াদে সরকার সড়কের শৃঙ্খলায় করণীয় সব জেনেছেন। এখন সময় এসেছে বাস্তবায়নের। সড়কে প্রাণহানি কমাতে প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে ৬টি নির্দেশনা দিলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে কতটুকু? এ প্রশ্ন এখন জনমনেও।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো: মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেটার সিংহভাগই বাস্তবায়ন হয়নি। স্বল্পতম সময়ে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া যায় সেগুলোতেও আমরা দৃশমান তেমন কিছু দেখতে পাচ্ছি না। সড়ক দূর্ঘটনা রোধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিতে পারেন, কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব হলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু তারা যদি গুরুত্বের সঙ্গে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করেন তাহলে তো কিছু করার নেই।’

তিনি বলেন, ‘আসলে আমরা যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি সেটায় আমরা দেশে সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র শতভাগ যে তুলে আনতে পেরেছি তা-ও কিন্তু নয়। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার সব খবর সংবাদপত্রে আসে না। আবার দূর্ঘটনার খবর সংবাদপত্র পর্যন্ত পৌঁছালেও অধিকাংশ সময় সেটা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের ভিড়ে হারিয়ে যায়। আমরা সব সময় সড়ক দূর্ঘটনার চিত্র তুলে ধরে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করি। কিন্তু সরকার সেটাকে পজিটিভভাবে না নিয়ে যদি নেগেটিভভাবে নেয় তাহলে তো আমাদের কিছু করার থাকে না।’

সড়ক দূর্ঘটনা কমিয়ে আনতে করণীয় জানতে চাইলে জানান, ট্রাফিক আইন, মোটরযান আইন ও সড়ক ব্যবহার বিধিবিধান সম্পর্কে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ও সাধারণের মধ্যে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে। একইসঙ্গে টিভি-অনলাইন, সংবাদপত্র ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সড়ক সচেতনতামূলক বা দূর্ঘটনা প্রতিরোধে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে।

জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কের পাশ থেকে হাট-বাজার অপসারণ, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, রোড সাইন (ট্রাফিক চিহ্ন) স্থাপন করা, জেব্রাক্রসিং দেওয়া, চালকদের পেশাগত প্রশিক্ষণ ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা, যাত্রীবান্ধব সড়ক পরিবহন আইন ও বিধিবিধান প্রণয়ন, গাড়ির ফিটনেস ও চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার পদ্ধতিগত উন্নয়ন-আধুনিকায়ন, জাতীয় মহাসড়কে কমগতি ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করা এবং লাইসেন্স নবায়নের সময় চালকদের জন্য ডোপ টেস্টের ব্যবস্থা করার কথা এসেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির সুপারিশে।

সড়কে দূর্ঘটনা রোধে করণীয় জানতে চাইলে সড়ক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. এস এম সালেহ উদ্দিন বলেন, ‘প্রথমে চালকদের বৈধ লাইসেন্স থাকতে হবে। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো যাবে না। গাড়ি চালানোর জন্য অবশ্যই গাড়িতে সিটবেল্ট রাখতে হবে এবং সেটা পরিধান করতে হবে। রাস্তায় জেব্রাক্রসিং নির্মাণ করেত হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক পরিবহন ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে। ঢাকার রাস্তায় মোটরবাইকের জন্য আলাদা লেন তৈরি করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে ৬টি নির্দেশনা দিয়েছেন সেগুলো কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে সেটা সবাই দেখতে পাচ্ছে। তবে আমার মনে হচ্ছে এটা মোটেও বাস্তবায়ন হয়নি। সড়কে সেই নৈরাজ্য এখনও বিদ্যমান। সঙ্গে এটা মানতে হবে যে, জনগণ কিছুটা সচেতন হয়েছে। এজন্যই আগের তুলনায় দুর্ঘটনা একটু কম হচ্ছে। সরকার পাঠ্যপুস্তকে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে একটা অধ্যায় সংযোজন করলে আরও ভাল হবে এবং পারিবারিকভাবেও সড়কে চলাচলের বিষয়ে সবাইকে শিক্ষা ও সচেতন করে তুলতে হবে।’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here