স্ত্রীর সামনে স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা; মূল আসামিরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে

0
494
বরগুনা হত্যাকাণ্ডঃ খুনিদের গ্রেফতারের নির্দেশনা চেয়ে রিট

খবর ৭১ঃ

বরগুনায় প্রকাশ্যে স্ত্রীর সামনে স্বামী রিফাত শরীফকে (২৫) কুপিয়ে হত্যার ঘটনার মূল দুই আসামি সাব্বির হোসেন নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী ধরা ছোঁয়ার বাইরে, অদৃশ্য এক শক্তির কারণে তাদেরকে এখন গ্রেফতার করা যায়নি। তারা এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারি; স্থানীয় একটি প্রভাবশালীচক্রের ছত্রচ্ছায়ায় থেকে তাঁরা মাদক, অস্ত্র, ছিনতাই, চুরি থেকে এমন কোন অপকর্ম নাই যার সংগে তারা জড়িত নয়। তাঁদের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলাও রয়েছে এবং জেলও খেটেছেন। জেল থেকে বেরিয়ে এসেই রিফাত শরীফকে খুন করেছেন। এ দুই খুনিকে এখনো গ্রেপ্তার করতে না পারলেও পুলিশ এ মামলার এজাহারভুক্ত অন্য দুই আসামিসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে ছেন।

গত বুধবার সকালে বরগুনা সরকারি কলেজ এলাকায় রিফাত শরীফকে তাঁর স্ত্রীর সামনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হলে টনকনরে প্রশাসনের। বরগুনা সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের বড় লবণগোলা গ্রামের আব্দুল হালিম দুলাল শরীফের একমাত্র ছেলে রিফাত। দুই মাস আগে বরগুনা পুলিশ লাইন এলাকার আয়েশা আক্তার মিন্নির সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে নয়ন তাঁকে উত্ত্যক্ত করে আসছিলো।

প্রভাবশালীদের ছত্রচ্ছায়ায় বেপরোয়া নয়ন-রিফাত ফরাজীঃ

রিফাতের খুনিদের একজন নয়ন যে স্থানীয়দের কাছে ‘নয়ন বন্ড’ নামেই পরিচিত। খুনিদের আরেকজন নয়নের ঘনিষ্ঠ বন্ধু রিফাত ফরাজী। দুজনই অনেক আগে থেকেই অপরাধ জগতের পরিচিত মুখ। নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজী চিহ্নিত সন্ত্রাসী বলে এলাকার লোকজন জানিয়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছাড়াও তাঁরা ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও মাদক কারবারে জড়িত। যাকে তাকে কুপিয়ে জখম, ছিনতাই, চাঁদাবাজি করে আসছেন তাঁরা। দুজনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে কোনো পর্যায়ের কমিটিতে নেই তাঁরা।

বরগুনা সরকারি কলেজের দক্ষিণ-পশ্চিমে পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে নয়নের বাসা। তাঁর বাবা মৃত ছিদ্দিকুর রহমান। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছোট। তাঁর বড় ভাই মিরাজ হোসেন সিঙ্গাপুর প্রবাসী। মাকে নিয়ে বরগুনার ওই বাসায় থাকেন নয়ন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে ১২ লাখ টাকার হেরোইন, দেশীয় অস্ত্র, ইয়াবা ও ফেনসিডিলসহ পুলিশের হাতে এক সহযোগীসহ গ্রেপ্তার হন নয়ন। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে বরগুনা সদর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ এবং অস্ত্র আইনে দুটি মামলা করে। মামলায় আসামি করা হয় নয়ন ও তাঁর সহযোগী ইমামকে। দীর্ঘদিন জেলে থাকার পর সম্প্রতি জামিনে বেরিয়ে আসেন নয়ন।

স্ত্রীর সামনে স্বামীকে কুপিয়ে হত্যা; মূল আসামিরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে
আসামি রিফাত ফরাজী ও নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড

নিজের বোনকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় বছর দুই আগে রাজু নামের এক যুবককে কুপিয়ে আহত করেন নয়ন। শহরের বড় বড় মাদক কারবারিদের সঙ্গে তাঁর সখ্য রয়েছে। আরেক খুনি রিফাত ফরাজী। পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের ধানসিঁড়ি রোডের মো. দুলাল ফরাজীর বড় ছেলে তিনি।

২০১৭ সালের ১৫ জুলাই সন্ধ্যায় তরিকুল ইসলাম (২১) নামের এক প্রতিবেশীকে কুপিয়ে মারাত্মক জখম করেন রিফাত ফরাজী। ঘটনার শিকার তরিকুল জানান, একদিন সামান্য কথা-কাটাকাটি হয় রিফাত ফরাজীর সঙ্গে। তখন রিফাত ফরাজী তাঁকে কুপিয়ে জখম করার হুমকি দেন। ভয়ে তিনি দেড় মাস রিফাত ফরাজীর বাসার সামনে দিয়ে না গিয়ে আধা কিলোমিটার পথ ঘুরে নিজের বাসায় যাওয়া-আসা করতেন। হুমকি দেওয়ার দেড় মাস পর একদিন সন্ধ্যায় রিফাত ফরাজীর বাসার সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন রিফাত তাঁকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে মাথায় গুরুতর জখম করেন। এ ঘটনায় তাঁর (তরিকুল) বাবা বাদী হয়ে একটি মামলা করেন।

একই বছর রিফাত ফরাজী বরগুনার হোমিও চিকিৎসক ডা. আলাউদ্দিন আহমেদের ডি কে পি রোডের বাসার ছাত্র মেসে গিয়ে ধারালো অস্ত্রের মুখে ছাত্রদের জিম্মি করে তাদের ১৪টি মোবাইল ছিনতাই করে পালিয়ে যান। এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ করা হলে পুলিশ রিফাতের বাবা দুলাল ফরাজীকে আটক করে মোবাইলগুলো উদ্ধার করে। বরগুনা সদর থানার ওসি আবীর হোসেন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘নয়ন বন্ডের মাদক বাণিজ্যের কথা আমরা জানি; তার বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র মামলাসহ একাধিক মামলার কথাও আমরা জেনেছি। রিফাতের বিরুদ্ধেও থানায় মামলা রয়েছে। দুজনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’

তিনজন গ্রেপ্তারঃ

রিফাত শরীফকে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা হলো চন্দন, হাসান ও নাজমুল। দুজনই মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। এর মধ্যে চন্দন এজাহারের চার নম্বর আসামি। এজাহারে নাজমুলের নাম নেই। তাঁকে ক্লোজ সার্কিট (সিসি) টিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে শনাক্ত করা হয়েছে। বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন এ তথ্য কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য একাধিক দল কাজ করছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।

নিহত রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে গত রাতে ১২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় ছয়জনকে আসামি করে বরগুনা সদর থানায় মামলাটি করেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন পুলিশের বরিশাল রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) শফিকুল ইসলাম ও বরগুনার পুলিশ সুপারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

ডিআইজি শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এমন একটি ঘটনা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। ঘটনাটি যেখানে ঘটেছে সেখানে পুলিশের সিসি ক্যামেরা রয়েছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে খুনিদের শনাক্ত করা গেছে। অভিযান চলছে, শিগগিরই অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হবে পুলিশ।’

শিক্ষার্থীদের মানববন্ধনঃ

রিফাতের হত্যাকারী চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বরগুনা সরকারি কলেজ ক্যাম্পাসে গতকাল সকালে মানববন্ধন করেছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি এ কলেজের ছাত্রী।

 

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here