সুনামগঞ্জের বাশঁতলা রুচিশীল প্রকৃতি প্রেমিদের মন কেড়েছে

0
567

হাবিবুর রহমান নাসির ছাতক সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি:
দোয়ারাবাজার ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নিয়ে এক সময়ে ছিল ছাতকের ব্যাপক বিস্তৃতি। ১৯৮৪ সালে উপজেলা পরিষদ গঠনের পর ১৩ ইউনিয়ন নিয়ে ছাতক ও ৭টি ইউনিয়ন নিয়ে দোয়ারাবাজার উপজেলা গঠিত হয়। কোম্পানীগঞ্জের অন্তর্ভূক্ত হয় আরো কয়েকটি ইউনিয়ন। ছাতক, কোম্পানীগঞ্জ ও দোয়ারাবাজার উপজেলার মধ্যে ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারী, বাশঁতলাসহ বিভিন্ন এলাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে অপূর্ব লীলা ভূমি হিসেবে যূগ যূগ ধরে সর্ব মহলে পরিচিত পেয়েছে। দোয়ারাবাজারের বাংলাবাজার ইউপির বাশঁতলা-হকনগর এখন ভারতের গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত দেশের একমাত্র ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে এ দেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু ১১টি সেক্টরের মধ্যে ১০টি সেক্টরই ছিল ভারতের অভ্যন্তরে। আর দেশের মধ্যে একটি সেক্টরই ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যার নাম ঐতিহাসিক বাঁশতলা। এখানে সরকার বিপুল অংকের টাকায় মুক্তিযোদ্ধের স্মৃতি সৌধ গড়ে তোলা হয়। সর্ব মহলে বাঁশতলা এখন পর্যটন এলাকা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কিছুদিন আগেও এ বাঁশতলার ইতিহাস ঐতিহ্য সম্পর্কে অনেকে অবগত ছিলনা। কিন্তু বাঁশতলা রুচিশীল প্রকৃতি প্রেমিদের মন কেড়েছে। ছাতকের সুরমা নদী পার হয়ে নোয়ারাইবাজার থেকে যেতে হয় বাঁশতলা। নদী পার হতে লাফার্জ ঘাটে ফেরি ও শহরের পশ্চিম বাজারে রয়েছে ইঞ্জিন চালিত নৌকা। এর পর সিএনজি চালিত অটোরিক্সা অথবা নিজেদের যানবাহনে বালিউরা ও বাংলাবাজার অতিক্রম করে প্রায় আড়াই ঘন্টা পথ চলার পর গারো পল্লীর দেখা মিলবে। এখানে ভারতীয় সীমানার কোল ঘেষে পাহাড়ের উপর গারো জাতির বসবাস। তাদের সাজানো-গোছানো ঘর-বাড়ির পরিবেশ অত্যন্ত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। গারো পাহাড়ের পাদদেশে ভারতের সীমান্ত। এখানের চারদিকে সবুজের সমারোহ। বিকেল বেলা পাখিদের কলরব ও বাতাসের মনমাতানে শব্দে প্রাণ জুড়ায়। ছোট ছোট টিলা আর পাহাড়ে সাজানো বিস্তীর্ণ এলাকা। দেখলে মনে হবে কেউ যেন চারিদিকে সবুজ রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে। ভারত সীমান্তে পাহাড়ী ঝরনা চোখে পড়ার মত। এখান থেকে ফিরে হকনগরস্থ মৌলা নদীর উপর ”সুইচ গেইট” দর্শন না করে যাওয়া য়ায় না। ১ কোটি ২৬লাখ ১০হাজার টাকা ব্যয়ে ২০০৫ সালে নির্মিত হয়। যদিও নদী শাসন প্রকৃতি বিরুধী তবুও বয়ে চলা পাহাড়ি ঝরনার মাঝে এ ”স্ইুচ গেইট” আলাদা সৌন্দর্য্যে সৃষ্টি করেছে। এখানে ঠান্ডা ও শীতল স্বচ্ছ পানিতে সাঁতার কাটলে সহজেই শরিরের ক্লান্তি দূর করে। সুইচ গেইটে পানির মনোহারি শব্দে গোটা এলাকা যেন মূখরিত হয়ে আছে। ”সুইচ গেইট” ছাড়িয়ে কিছুটা সামনে আগালেই দেখা মিলবে মুক্তিযুদ্ধের ৫নং সেক্টর সদর দপ্তর। এখানে কিছুটা ত্রিভুজ আকৃতির শহীদ মিনারের বেধিতে বসলে প্রাকৃতিক ঠান্ডা বাতাস মন ছুয়ে যাওয়ার মত মনোরম দৃশ্য। সবুজ পাহাড় আর নীল আকাশের মিতালি দেখে মনে হবে যেন ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমিয়ে আছে।’ জানা গেছে, বাঁশতলাসহ এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় যারা শহীদ হয়েছেন তাদেরে সমাহিত করা হয়েছে এখানেই। এসব শহীদদের স্মৃতি অম্লান করে রাখার জন্যে হকনগর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। সরকারী অর্থায়নে হকনগর স্মৃতি সৌধ এলাকায় পর্যটকদের জন্যে নির্মাণ করা হয়েছে একটি রেষ্ট হাউজ, হকনগর কমিউনিটি ক্লিনিক, মসজিদসহ বিভিন্ন স্থাপনা। স্মৃতি সৌধের পাশে রয়েছে দু’শতাধিক বছরের পুরোনো আদিবাসী পাহাড়। এখানে রয়েছে গারোদের বসবাস। পাহাড়ে উঠলে প্রকৃতির প্রকৃত চেহারা অবলোকন করতে প্রত্যহ হাজারো প্রকৃতি প্রেমীরা ভীড় জমায়। ঝুমগাঁও এলাকায় বসবাস করে আদিবাসী গারো সম্প্রদায়ের প্রায় ২৫টি পরিবার। তারা নিজ হাতে তৈরী করে নিজেদের ব্যবহার্য যাবতীয় আসবাব পত্র। গারো পাহাড়ে রয়েছে একটি মিশনারী স্কুল, একটি উপাসনালয় ও পাহাড়ের চুড়ায় উঠার জন্যে সরকারী অর্থায়নে নির্মিত একটি সিড়ি। সব মিলিয়ে পর্যটকদের মন কাড়ার মতো পরিবেশ। কিন্তু সব কিছুকে ম্লান করে দিয়েছে একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা। দু’টি রাস্তাই চলাচলের ক্ষেত্রে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ন। সুরমা ব্রিজের কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় গোবিন্দগঞ্জ-ছাতক-দোয়ারাবাজার ও ছাতক-বাংলাবাজার-বাঁশতলা সড়কে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়নি। সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ খুবই আতিথেয়তা পরায়ন। যুদ্ধের সময়ে যেভাবে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছেন সেই ধারাবাহিকতায় এখনো তাদের মধ্যে পর্যটকদের আদর আপ্যায়নে সদা হাসৌজ্জল পরিবেশ বজায় রেখেছে। দেখলে তাদেরকে অত্যন্ত সহজ-সরল প্রকৃতির মনে হয়। ফরিদপুর থেকে আগত পর্যটক সিকদার কামরুল ইসলাম জানান, এখানে খাবারের ভাল হোটেল নেই। এজন্যে দূর-দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকদের সমস্যায় পড়তে হয়। এ ব্যাপারে হকনগর বাজারের ব্যবসায়ি মোশারফ মজুমদার, সমাজসেবী আব্দুল মজিদ, বাবুল মিয়া, বদরুল ইসলাম জানান, ছাতকের জিয়াপুর নিবাসী তৎকালীন এমএলএ মরহুম আব্দুল হক মুক্তিযোদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্যে তাঁর জীবদ্দশায়ই এলাকাবাসী তার নামানুসারে গ্রামের নাম হকনগর রাখেন। এ সময় মহান মুক্তিযুদ্ধ চলছিল। যুদ্ধচলাকালিন সময়ে তিনি এখানে প্রতিষ্টা করেন একটি মেডিকেল হাসপাতাল। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাসহ এলাকার বিপুল সংখ্যাক রোগীর চিকিৎসা সেবা দেয়া হতো এ হাসপাতালে। হক নগর প্রাথমিক বিদ্যালয় নামেও তিনি একটি শিক্ষা প্রতিষ্টান গড়ে তোলেন। এখনও মরহুম আব্দুল হকের নামানুসারে হকনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হকনগর প্রাম ও হকনগর স্মৃতিসৌধসহ বিভিন্ন প্রতিষ্টান থাকলেও কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে হকনগর হাসপাতালটি। এক সময়ে হকনগর হাসপাতালে নরসিংপুর, বাংলাবাজার, বগুলা, লক্ষীপুরসহ বিভিন্ন ইউনিয়নের বিপুল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা গ্রহন করতো। কিন্তু এখন এটি বন্ধ থাকায় হকনগর কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্টা করলেও প্রায়ই এটির দরজায় তালা ঝুলানো থাকার অভিযোগ ভুক্তভোগীদের। এখানে পরিবার পরিকল্পনাসহ অন্যান্য বিষয়ে পরামর্শ দেয়া হলেও চিকিৎসা সেবার জন্যে কোন ডাক্তার নেই। এজন্যে এলাকার বিপুল সংখ্যক লোক চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। এলাকাবাসী মরহুম এমএলএ আব্দুল হক প্রতিষ্টিত অন্যান্য প্রতিষ্টানের ন্যায় হকনগর হাসপাতাল পূনঃ প্রতিষ্টার জন্যে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপকের কাছে দাবী জানিয়েছেন। তাদের দাবি হচ্ছে, যুদ্ধকালিন সময়ে শুধু ক্যাপ্টেন হেলাল ও এমএলএ আব্দুল হকের বর্নাঢ্য অবদানের সাথে এলাকাবাসীও সার্বিক সহযোগিতা ছিল চোখে পড়ার মতো। সরকার দ্রততম সময়ের মধ্যে হকনগর-বাংলাবাজার-দোয়ারাবাজার সড়কটি সংস্কারের পাশাপাশি হকনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নির্মানের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত হকনগর এলাকার মানুষের কল্যানে এগিয়ে আসবেন এমনটাই প্রত্যাশা। এ ব্যাপারে উপজেলা চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা অধ্যক্ষ ইদ্রিস আলী বীরপ্রতিক জানান, বর্তমান সরকার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখার জন্যই কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেন এবং প্রতি বছরই স্বাধীনতা, বিজয় দিবসহ অন্যান্য দিবসে ধুমধামের মাধ্যমে অনুষ্ঠান পালণ করা হয়। হকনগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য সরকারের উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষ বরাবারে আবেদন জানানো হবে এবং বর্তমান সরকারের আমলেই রাস্তাটি সংস্কার ও প্রশস্থ করা হবে।
খবর ৭১/ ই:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here