সাইবেরিয়ার গহীনে যেভাবে গড়ে উঠেছিল বিজ্ঞান নগরী

0
309

খবর৭১:১৯৫৭ সালে সাইবেরিয়ার গভীরে একটা বিজ্ঞাননগরী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয় সোভিয়েত সরকার। শহরের নাম দেওয়া হয় অ্যাকাডেমিক সিটি বা আকাদেমগোরোদক।

সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় শিক্ষাবিদদের শহর নামে পরিচিত হয়ে ওঠা ওই শহরে কাজ করতে যাবেন হাজার হাজার বিজ্ঞানী। অ্যাকাডেমিক সিটিতে প্রথম যেসব বিজ্ঞানী কাজ করতে গিয়েছিলেন তাদের একজন ছিলেন ভিক্টর ভারান্ড।

‘সেখানে সবকিছুই ছিল আলাদা। বাড়িগুলো একেবারে জঙ্গলের মাঝখানে। চারদিক নিঝুম। বাতাস খুব পরিষ্কার। নভেম্বরে যখন তুষার পড়ত, রাস্তাঘাট সব সাদা হয়ে যেত- একদিন-দুইদিন- এক সপ্তাহ পর্যন্ত বরফ গলত না। কখনো কখনো এক মাস পর্যন্ত বরফ থাকত। ‘

ভিক্টর ভারান্ড সেখানে গিয়েছিলেন তার স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে নিয়ে।

১৯৬২ সাল থেকে সেখানে তিনি কাজ করেছিলেন ৪৬ বছর। ইনস্টিটিউট অব ইনঅরগ্যানিক কেমিস্ট্রি সংস্থায় রসায়ন বিজ্ঞানের গবেষক হিসেবে তিনি সেখানে কাজে যোগ দেন।
ওই নতুন শহর যার নাম দেওয়া হয় আকাদেমগোরোদক বা অ্যাকাডেমিক সিটি, সেখানে বাসিন্দা তখন ২৫ হাজার, যাদের প্রায় সবাই হয় বিজ্ঞানী, নয় বিজ্ঞানী হতে যাচ্ছেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠানে যারা কাজ করছেন তাদের গড় বয়স তিরিশের নিচে।

শহর গড়ে তোলা হয়েছে একেবারে সাইবেরিয়ার বরফঢাকা বিরানভূমির মাঝখানে, গহীন জঙ্গলে, জীবনধারণ যেখানে কঠিন। কিন্তু ভিক্টর ভারান্ডের মতে ওই গহীন জঙ্গলের মাঝে বিজ্ঞানীদের জন্য শহর বানানোর একটা যৌক্তিকতা ছিল।

‘সেখানে গভীর বনজঙ্গলে ছিল প্রচুর গাছগাছালি, খনিজ সম্পদ ছিল অঢেল। এসব সম্পদের সন্ধান এবং কীভাবে সেসব আহরণ করতে হয় ব্যবহারের জন্য- তা জানা দরকার ছিল। এ কারণে ওই বনভূমিতে তৈরি হয়েছিল আকাদেমগোরোদক। ‘

তিনি বলেন, ‘সোভিয়েতরা বিজ্ঞানের সেবায় উৎসর্গ একটা নগরী গড়ে তোলার জন্য ১৯৫৭ সালটা বেছে নিয়েছিল তার মূল কারণ দেশে তখন বিজ্ঞানীদের একটা অভাব তৈরি হয়েছে। ‘

‘যুদ্ধের সময় ১৯২০ থেকে ৩০-এর দশকে সোভিয়েতরা বিজ্ঞান চর্চায় পিছিয়ে পড়েছিল। কারণ বহু নামকরা প্রথম সারির বিজ্ঞানী এমনকি নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীরাও হয় দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন, নয় তাদের জেলে ভরা হয়েছিল। কাজেই নতুন বিজ্ঞানী তৈরি করা জরুরি হয়ে পড়েছিল। ‘

জারের সময় থেকে লোকজনকে নির্বাসনে পাঠাতে হলে পাঠানো হতো সাইবেরিয়ায়।

‘আপনি কি কাউকে ভালো জায়গায় নির্বাসনে পাঠাবেন? সাইবেরিয়া বলতে লোকের মনে একটা ভয়ঙ্কর জায়গার ছবি ভাসত- যেখানে নেকড়ে মানুষ খেয়ে ফেলে। রাশিয়ার অন্য জায়গা থেকে বিজ্ঞানীরা সাইবেরিয়ায় যাওয়ার কথা শুনে ভয় পেত- কারণ মস্কো বা লেনিনগ্রাড থেকে সাইবেরিয়া ছিল অনেক দূরে, বলছিলেন ভিক্টর ভারান্ড।

বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া ওই অ্যাকাডেমিক সিটি বা বিজ্ঞান নগরীতে গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান- যেগুলো বিজ্ঞানের বিশেষ বিশেষ শাখা নিয়ে গবেষণার কাজ করত। কিন্তু তাদের পরস্পরের মধ্যে সম্বন্বয় ছিল- সংযোগ ছিল।

ওই নগরীতে সবপ্রথম যে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে তাদের কাজ ছিল জলসম্পদ নিয়ে। ইনস্টিটিউট অব হাইড্রো ডায়নামিক্স। এই সংস্থার পরিচালক মিখাইল লাভরেনত্যিফ ছিলেন গোটা আকাদেমগোরোদকের প্রধান। তাকে মস্কো থেকে সাইবেরিয়ায় যেতে রাজি করাতে লোভ দেখানো হয়েছিল যে সেখানে গবেষণাগারের সরঞ্জামের জন্য বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা হবে।

‘তারা আমাদের বেতন নিয়ে লোভ দেখায়নি। দারুণ সব কাজের সুযোগ এবং ভালো বাসস্থানের সুযোগ আমাদের আকৃষ্ট করেছিল। সেখানে পৌঁছামাত্র ওরা আমাদের ভালো বাসাবাড়ি দিয়েছিল। সেসময় সোভিয়েত ইউনিয়নে বাসস্থানের দারুণ সংকট ছিল। বেশিরভাগ তরুণ- এমনকী বিয়ের পর – বাচ্চাকাচ্চা হয়ে যাওয়ার পরও থাকত বাবা-মায়ের সঙ্গে। আমরা অবশ্যই চাইতাম স্বাধীনভাবে থাকতে- কিন্তু সামর্থ্যে কুলাত না। ‘

এ ছাড়া সোভিয়েত ইউনিয়নে তখন ছিল খাদ্য সংকট। আর কি খাবার কে পাবে- তা নির্ভর করত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পদমর্যাদা অনুযায়ী।

‘যারা শিক্ষাবিদ ছিলেন এবং যাদের ডক্টরেট ডিগ্রি ছিল তাদের বাসায় খাবার পৌঁছে দেওয়া হতো। শিক্ষাবিদদের ভালো খাবার খাওয়ার সুযোগ ছিল। তারা ফল, নানা ধরনের মাংস, সসেজ এবং পনির খেতে পারতেন। ‘

কিন্তু ওই বিজ্ঞান নগরীতে সাধারণ বাসিন্দাদেরও ছিল ভালো খাবার খাওয়ার সুযোগ। ভিক্টর ভারান্ডের স্ত্রীও ছিলেন বিজ্ঞানী। তার স্ত্রী প্রথমে গিয়েছিলেন অ্যাকাডেমিক সিটিতে। পরে ছেলেকে নিয়ে সেখানে যান ভিক্টর ভারান্ড।

তার মতো প্রতিভাবান বিজ্ঞানীরা ওই জনহীন প্রত্যন্ত সাইবেরিয়ায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করে যেতেন, কারণ তারা চাইতেন এমন কিছু করতে যা উৎসাহ- উদ্দীপনা জোগায় এবং যা মানুষের কাজে লাগে। এ ছাড়া কাজের জন্য সেখানে বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম পাওয়া দেশের অন্যান্য জায়গার তুলনায় সহজ ছিল, যদিও আমলাতান্ত্রিকতা ছিল পদে পদে।

সেখানে যারা কাজ করতেন তাদের জন্য আরেকটা বড় সুবিধা ছিল শিক্ষা নগরীতে ছেলেমেয়েদের ভালো স্কুলে লেখাপড়ার সুযোগ।

নতুন নগরীতে ব্যতিক্রম এক স্কুলে উন্নত ধরনের শিক্ষার সুযোগ ছিল। ওই স্কুলে প্রতিবছর সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন অংশ থেকে সবচেয়ে প্রতিভাবান ছেলেমেয়েরা ভর্তি হতো। দেশব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থী বাছাই করা হতো। ওই স্কুল ছিল মেধাবীদের পীঠস্থান।

তবে সাইবেরিয়ায় অ্যাকাডেমিক সিটিতেও বিজ্ঞানীরা তাদের কাজে, ভাবনায় বা কথাবার্তায় স্বাধীন ছিলেন না। ভিক্টর বলছেন ১৯৩০ এর দশকে স্তালিনের দমননীতির যুগ থেকে মানুষের যে শিক্ষা হয়েছিল তার আলোকে অবশ্যই মানুষ চুপচাপ থাকত।

‘আমরা ভাবতাম একরকম -কিন্তু মুখ খুলতাম যখন-তখন বলতাম অন্য কথা। অভিজ্ঞতাই আমাদের এভাবে কথা বলতে শিখিয়েছিল। কম্যুনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস সকলের ছিল না। ‘

বিজ্ঞানীদের ওই শিক্ষানগরীতে অনেক পরস্পরবিরোধী ব্যাপার ছিল। মানুষ একদিকে জ্যায সংগীত শুনত- কিন্তু অন্যদিকে মুখ বুজে থাকত- বাক স্বাধীনতা ছিল না। একদিকে গবেষণার জন্য প্রচুর অর্থ ঢালা হতো- আধুনিক গবেষণাকে উৎসাহিত করা হতো- কিন্তু গবেষণার সরঞ্জাম কেনার জন্য এক বছর আগে অর্ডার দিতে হতো- পুরনো আমলাতান্ত্রিকতা থেকে রেহাই ছিল না।

তারপরও বিজ্ঞানীরা মনে করেন ৬০ বছর আগে গড়ে তোলা অ্যাকাডেমিক সিটি বা বিজ্ঞান-নগরীর পরীক্ষা সফল হয়েছিল।

‘অবশ্যই এই শহর একটা বিরাট অর্জন। নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানীদের এখানে লালন করা হয়েছে। যারা এখন এখানে কাজ করছেন তারা এখানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্নাতক। রাশিয়ার মূল সম্পদ এখন কী? তেল আর গ্যাস। কারা এই সম্পদ খুঁজে পেয়েছে – কারা তা উত্তোলন করেছে? আমাদের এই সাইবেরিয়ার বিজ্ঞানীরাই, ‘ইতিহাসের সাক্ষী অনুষ্ঠানে বলেছেন বিজ্ঞানী ভিক্টর ভারান্ড, যিনি এখনো থাকেন অ্যাকাডেমিক সিটিতে।
খবর৭১/জি:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here