সব ঋণে সর্বোচ্চ সুদ ৯ শতাংশ

0
593
সব ঋণে সর্বোচ্চ সুদ ৯ শতাংশ

খবর৭১ঃ অবশেষে ঋণ ও বিনিয়োগের সর্বোচ্চ সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিট কার্যকর করার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একমাত্র ক্রেডিট কার্ড ছাড়া সব ধরনের ঋণ ও বিনিয়োগের ওপর সর্বোচ্চ সুদের হার হবে ৯ শতাংশ।

ব্যাংকগুলো প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে এর চেয়ে কম সুদও নির্ধারণ করতে পারবে। তবে কোনোক্রমেই ৯ শতাংশের বেশি সুদ নেয়া যাবে না। নিয়মিত ঋণ বা বিনিয়োগের বিপরীতে অতিরিক্ত কোনো মুনাফা বা দণ্ডসুদও আরোপ করা যাবে না।

সোমবার এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটি ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে। এতে আরও বলা হয়, কেবল গ্রাহক কোনো কারণে ঋণখেলাপি হলে ওই সময়ের জন্য ঋণের স্থিতি বা কিস্তির বিপরীতে ৯ শতাংশের বাইরে অতিরিক্ত ২ শতাংশ দণ্ডসুদ আরোপ করা যাবে।

রফতানির ঋণের সুদের হার ৭ শতাংশে অপরিবর্তিত থাকবে। তবে ৬ শতাংশে আমানত নেয়ার ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়নি। বিষয়টি ব্যাংকারদের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ব্যাংকগুলো তাদের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় কম রাখার চেষ্টা করবে।

এতে স্বাভাবিকভাবেই আমানতের সুদের হার কম হবে। বিষয়টি ব্যাংকগুলোই এখন প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে নিরূপণ করবে। ঋণের সর্বোচ্চ সুদ বেঁধে দেয়া হয়েছে। এখন এর ওপর ভিত্তি করেই আমানত সংগ্রহ ও অন্যান্য খরচ মেটানো হবে।

আরও জানা গেছে, উল্লিখিত প্রজ্ঞাপন জারি করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের কাছে পাঠানো হয়েছে। ব্যাংকগুলো যাতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারে, সেজন্য এক মাসের বেশি সময় দেয়া হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই সার্কুলার জারির ফলে ঋণ ও বিনিয়োগের সুদের হার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনা ব্যাংকগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক হল। এতদিন ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার জন্য সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে গভর্নর পর্যন্ত বলার পরও ব্যাংকগুলো তা কার্যকর করেনি।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, কোনো গ্রাহক এই নীতিমালার আওতায় ঋণ নিয়ে খেলাপি হলে তিনি আর এই সুবিধা পুরোপুরি পাবেন না। মেয়াদি ঋণের ক্ষেত্রে যে সময়ের জন্য গ্রাহক খেলাপি হবেন, ওই সময়ের জন্য খেলাপি কিস্তির ওপর এবং চলতি মূলধন ঋণ হলে বকেয়া স্থিতির ওপর অতিরিক্ত ২ শতাংশ হারে দণ্ডসুদ দিতে হবে। অর্থাৎ গ্রাহক খেলাপি হলে ঋণের সুদ দাঁড়াবে ১১ শতাংশে।

প্রিশিপমেন্ট রফতানি ঋণের জন্য বর্তমানে ৭ শতাংশ সুদ বিদ্যমান রয়েছে। এই হার অপরিবর্তিত থাকবে। নিয়মিত ঋণের বিপরীতে ৯ শতাংশে বাইরে অন্য কোনো সুদ বা দণ্ডসুদ বা মুনাফা আরোপ করা যাবে না। কেবল খেলাপি হলে ২ শতাংশ দণ্ডসুদ আরোপ করা যাবে। এর বাইরে অন্য কোনো সুদ বা মুনাফা আরোপ করা যাবে না।

সার্কুলারে আরও বলা হয়, চলতি বছর থেকে এসএমইর উৎপাদন খাতসহ শিল্প খাতে বিতরণ করা ঋণের আগের তিন বছরের গড় হারের চেয়ে কোনোভাবেই কম হতে পারবে না।

প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, বর্তমানে ব্যাংকগুলো ঋণের উচ্চ সুদহারের কারণে ক্ষুদ্র, মাঝারি, বড় শিল্পসহ ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং সেবা খাতের বিকাশ অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। চড়া সুদের কারণে ব্যবসায় খরচ যেমন বাড়ছে, তেমনি বেড়ে যাচ্ছে পণ্যের উৎপাদন খরচ।

এতে উৎপাদিত পণ্য প্রতিযোগিতামূলক দামে বাজারজাতকরণ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিকূল পরিবেশে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। এতে অনেকে সময় মতো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন। এতে ব্যাংকিং খাতে ঋণশৃঙ্খলা বিঘ্নিত হয়। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়।

এতে আরও বলা হয়, সামগ্রিকভাবে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশ এবং আন্তর্জাতিক বাজারে অধিক সক্ষমতা অর্জনে নীতি সহায়তা করার সুদের হার কমানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে দেশে শিল্প ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি হবে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে, ঋণ পরিশোধে গ্রাহকদের সক্ষমতা বাড়াবে। একই সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হবে।

ক্রেডিট কার্ডের সুদের হার এর আওতায় রাখা হয়নি।

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ১৪ মে গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী প্রথমবারের মতো ঋণের সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সভাপতি ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। তাকে লক্ষ্য করেই তিনি এই নির্দেশ দিয়েছিলেন।

পরে সে নির্দেশ অনুযায়ী তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান গভর্নর ঋণের সুদের হার কমাতে নানামুখী উদ্যোগ নেন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়। এর আলোকে অর্থমন্ত্রী চিঠি দেন বাংলাদেশ ব্যাংককে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে আলাদা বৈঠক করে ঋণের সুদের হার কমানোর জন্য তাদের বার্তা দেন। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর এ বার্তা কাজী আকরাম উদ্দিন আহমদও ব্যাংকের পরিচালকদের দেন।

এর আলোকে গত বছরের ২০ জুন বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সভায় সব ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশে এবং ছয় মাস মেয়াদি আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয়।

সুদের এই হার তারা ওই বছরের ১ জুলাই থেকে কার্যকর করার কথা জানায়। কিন্তু ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে এই সিদ্ধান্ত সরকারি চার ব্যাংক ছাড়া কোনো ব্যাংকই কার্যকর করেনি। এরপর একাধিকবার এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী কথা বললেও কোনো কাজ হয়নি।

১ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, শিগগিরই শিল্পঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহারের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ ব্যাহত হচ্ছে। একই দিন রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর এসএম মনিরুজ্জামানকে প্রধান করে ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়।

কীভাবে দেশের উৎপাদনশীল খাতে ঋণের সুদহার কমিয়ে আনা যায়, সে বিষয়ে একটি সুপারিশমালা তৈরি করেন তারা। সে সুপারিশের ভিত্তিতে ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পর্ষদ সভায় শিল্পঋণে ৯ শতাংশ সুদ অনুমোদন দেয়া হয়। ওইদিন জানানো হয়, বিষয়টি কার্যকরের বিষয়ে শিগগিরই প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।

সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২০ সালে ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে পরিবর্তন করা হয় সিদ্ধান্ত। ৩০ ডিসেম্বর ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবি এবং এমডিদের সংগঠন এবিবির সঙ্গে বৈঠক শেষে ব্যাংক আমানতে ৬ ও ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার বাস্তবায়ন শুরুর কথা জানান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।

অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে ২০ জানুয়ারি জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সরকারি আমানত বেসরকারি ব্যাংকে জমা রাখলে সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৬ শতাংশ। আর রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে রাখলে এ আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার ৫ দশমিক ৫০ শতাংশের বেশি হবে না।

একই সঙ্গে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বাধ্যতামূলকভাবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোয় রাখার বিষয়েও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ফলে সরকারি আমানত সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদে পাবে ব্যাংকগুলো।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক যুগান্তরকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার দাবি জানিয়ে আসছেন।

এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনে সে দাবি পূরণের পথে, এটাকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্যের যে অবস্থা তাতে দণ্ডসুদ আরোপের বিষয়টি কিছুটা শিথিল করা দরকার। কেননা নতুন করে করোনাভাইরাসের প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, দেশে শিল্পায়নের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদ ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি করে আসছি দীর্ঘদিন ধরে। অবশেষে তা কার্যকরে বাংলাদেশ ব্যাংক যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে একে আমরা স্বাগত জানাই। তবে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের যে প্রভাব, সে ক্ষেত্রে বাস্তব কারণে কেউ খেলাপি হয়ে গেলে তাকে ছাড় দিতে হবে।

এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেছেন, ঋণের সুদ বেশি হওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। সুদের হার কমানোর ফলে খরচ কিছুটা কমানো যাবে। এতে বিদেশে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা কিছুটা হলেও বাড়বে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here