শেরপুরে অন্তঃসত্ত্বাকে গাছে বেঁধে নির্যাতন : এবার পাল্টে গেল ভিকটিমের চিকিৎসা সনদ

0
699

শেরপুর থেকে আবু হানিফ : শেরপুরের নকলায় ডলি খানম নামে এক অন্তঃস্বত্ত্বা গৃহবধূকে গাছে বেঁধে নির্যাতনের চাঞ্চল্যকর মামলায় এবার সেই ভিকটিমের চিকিৎসা সনদ পাল্টে ফেলার অভিযোগ উঠেছে। আর ওই ঘটনায় অভিযোগ আনা হয়েছে খোদ সিভিল সার্জন ও জেলা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ রেজাউল করিম, একই হাসপাতালের আরএমও ডাঃ নাহিদ কামাল ও ময়মনসিংহের মির্জা প্যাথলজির প্রধান ডাঃ মির্জা হামিদুল হকের বিরুদ্ধে। ভিকটিমের পরীক্ষা-নিরীক্ষার সকল রিপোর্ট পজেটিভ থাকার পরও মামলায় এক সেনা সদস্যসহ আসামি পক্ষ এবং ঘটনা ধামাচাপায় জড়িত প্রভাবশালী মহল প্রথমত জেলা সদর হাসপাতালের আরএমওকে ম্যানেজ করে ওই চিকিৎসা সনদে ঘাপলার কাজটি করেছেন বলে নির্যাতিতা গৃহবধূর স্বামীর দেওয়া স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও জেলা প্রশাসক বরাবর এক অভিযোগে বলা হয়েছে। এতে একদিকে নির্যাতনে অকাল গর্ভপাতের পরও চিকিৎসা সনদ পাল্টে ফেলা এবং অন্যদিকে একজন আসামি ছাড়া অন্য কোন আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় খোদ ঘটনার ন্যায়বিচার নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে নির্যাতিতা গৃহবধূর পরিবার, তার পাশে দাঁড়ানো নারী, মানবাধিকার ও সামাজিক সংগঠনসহ সচেতন মহল।
নির্যাতিতা গৃহবধূর পরিবার, চিকিৎসা গ্রহণকারী হাসপাতাল ও সংশ্লিষ্ট সূত্রসহ অভিযোগে প্রকাশ, নকলা পৌর এলাকার কায়দা গ্রামের ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা, কলেজ শিক্ষার্থী ওই অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূকে গত ১০ মে জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে স্থানীয় প্রতিপক্ষের লোকজন গাছে বেঁধে নির্যাতনের পর রক্তক্ষরণে তিনি প্রথমে নকলা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়ে সেখানে টানা ৭দিন চিকিৎসা নেন। কিন্তু শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় রেফারমতে জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সেখানেও আরও ৭দিন চিকিৎসা গ্রহণ করেন। আর ওই সময়ে তার বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয় জেলা সদরের কেয়ার ডিজিটাল ডায়াগনোস্টিক সেন্টার ও জামান মডার্ণ হাসপাতালসহ ময়মনসিংহের চরপাড়ার মির্জা প্যাথলজি থেকে। ওইসব রিপোর্ট অনুযায়ী নির্যাতনের কারণে ওই গৃহবধূর ৩ মাসের সন্তান নষ্ট হওয়ার আলামত (ইনকমপ্লীট অ্যাবোরশন) পাওয়া যায়। ভিকটিমের স্বামী শফিউল্লাহর লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, নির্যাতনে গৃহবধূর গর্ভের সন্তান নষ্ট হওয়ার আলামত পাওয়ার পরপরই স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের তদবিরে জেলা সদর হাসপাতালের দায়িত্বপ্রাপ্ত আরএমও তা পাল্টে দিতে বিশেষ মিশন শুরু করেন। যে কারণে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্টসহ ২ হাসপাতালের ছাড়পত্রে ইনকমপ্লীট অ্যাবোরশন উল্লেখ থাকায় তিনি এমসি না ছেড়ে প্রথমে শফিউল্লাহকে ৪/৫দিন ঘুরাতে থাকেন। ওই অবস্থায় হঠাৎ তার ভিন্নতর ভূমিকায় সন্দিহান হয়ে তিনি বিষয়টি জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে অবহিত করেন। এরপরও সিভিল সার্জনের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু এখন চিকিৎসা সনদে গর্ভপাতের কথা নেই। শফিউল্লাহর অভিযোগ, ওই মামলার একজন আসামি সেনা সদস্য। কাজেই প্রভাবশালী মহল বিতর্কিত আরএমও’র মাধ্যমেই ওই এমসি হাসিল করেছেন। তার অভিযোগের প্রেক্ষিতে বোর্ড গঠন হলেও সিভিল সার্জন ও আরএমও’র যোগসাজসে মোটা অংকের নগদ-নারায়ণ হাতিয়ে নিয়ে মূল কাজটি হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। তার প্রশ্ন, হুইপ আতিকের উপস্থিতিতে সম্প্রতি জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভায় আরএমও’র বিরুদ্ধে এমসি বাণিজ্যের বিষয়ে রেজুলেশন হওয়ার পরও তিনি কিভাবে টিকে থাকেন? তার খুটির জোরই বা কোথায়?
নির্যাতিতা ডলি খানম চিকিৎসা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষায় পজেটিভ রিপোর্ট পাওয়ার পরও ভিন্নতর এমসি প্রদানে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, সংশ্লিষ্ট সকল কাগজপত্র হাতে রয়েছে। আইনি লড়াই চালিয়ে যাব। আর সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট প্রদীপ দে কৃষ্ণ বলেন, চাঞ্চল্যকর ওই ঘটনায় দেশবাসীর বিবেক নাড়া দিলেও সবকিছ্ ুঠিক থাকার পরও ভিন্নতর এমসি প্রদানের বিষয়টি অনভিপ্রেত। এর মধ্য দিয়ে এবার দায়িত্বশীল মেডিকেল অফিসারদের ভূমিকাটাও পরিস্কার হল। তবে এটাই শেষ কথা নয়। তার অকাল গর্ভপাতের বিষয়টি মূল ঘটনার একটি অংশমাত্র। তাই এটি না পেলেও ঘটনা মিথ্যা হল না। কারণ তাকে গাছে বেঁধে যৌনাঙ্গসহ শরীরে বর্বর নির্যাতনের ভিডিওতে পরিস্কার যে, আসামিরা কি করেছে।
অন্যদিকে এমসি প্রদানে ঘাপলা-অনিয়মের অভিযোগ প্রসঙ্গে বক্তব্য জানতে আরএমও ডাঃ নাহিদ কামালের মুঠোফোনে একাধিক দফায় যোগাযোগের চেষ্টা করেও বক্তব্য জানা যায়নি। তবে এমসি প্রদানের কয়েকদিন আগে তিনি রিপোর্ট পর্যালোচনায় অকাল গর্ভপাতের বিষয়টি পজেটিভ বলে স্বীকার করেছিলেন। একইভাবে মির্জা প্যাথলজির প্রধান মির্জা হামিদুল হকের বক্তব্য জানা যায়নি। তবে মেডিকেল বোর্ডের এক সদস্য ও গাইনি সার্জন ডাঃ লুৎফর রহমান বলেন, উচ্চতর রিপোর্টে অর্থাৎ মির্জা প্যাথলজির হিস্টোপ্যাথলজির রিপোর্টে নেগেটিভ পাওয়া গেছে। বোর্ড সে প্রেক্ষিতেই মতামত দিয়েছে। বোর্ডের সামনে অন্যান্য প্যাথলজির রিপোর্টসহ ছাড়পত্র উপস্থাপন হয়েছিল কিনা সে বিষয়টি পাশ কাটিয়ে তিনি বলেন, যা কিছুই হয়ে থাকুক না কেন যেটা সঠিক মনে হয়েছে সেটাই দেওয়া হয়েছে। অনেকটা একই কথা জানান সিভিল সার্জন ডাঃ রেজাউল করিম। তিনি বলেন, আলট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টের চেয়ে অবশ্যই হিস্টোপ্যাথলজি রিপোর্ট গ্রহণযোগ্য। তাই সে অনুযায়ী প্রতিবেদন দিয়েছে মেডিকেল বোর্ড। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভিকটিমের স্বামীর লিখিত অভিযোগের কারণে আরওমওকে বাদ দিয়ে ৪ সদস্যের বোর্ড গঠন করে দেওয়া হয়েছিল। আর তার যোগসাজসে আরএমও মির্জা প্যাথলজির মাধ্যমে রিপোর্ট পাল্টানোর মূল কাজটি করেছেন- এমন অভিযোগ তিনি অস্বীকার করে বলেন, আজ আমি নিজেও রিপোর্টগুলো আরএমও কাছ থেকে আনিয়ে দেখেছি।
এ ব্যাপারে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও নকলা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) সজিব রহমান বলেন, ভিকটিমের মেডিকেল রিপোর্টে সিম্পল ফিজিক্যাল অ্যাসাল্ট পাওয়া গেলেও ইনকমপ্লীট অ্যাবোরশনের কথা বলা হয়নি। ওই চিকিৎসা সনদে ২ হাসপাতালের ছাড়পত্র ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে কিনা তা অস্বীকার করে বলেন, সেগুলো আমাদের দেখার বিষয় নয়। তবে অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো ৩টি প্রতিষ্ঠান প্রধানের সাথেই তিনি কথা বলেছেন। অন্যান্য প্রতিষ্ঠান তাদের দেওয়া রিপোর্টের পক্ষে কথা বললেও মির্জা প্যাথলজির প্রধান আগের রিপোর্টটি দেননি বলে দাবি করেছেন। এছাড়া মামলায় এক নারী আসামি ধৃত হয়ে হাজতে এবং ৬ জন উচ্চ আদালত থেকে অর্ন্তবর্তীকালীন জামিনে থাকায় পলাতক অপর ২ আসামিকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। খুব দ্রুতই আদালতে চার্জশীপ দাখিল করা হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
উল্লেখ্য, গত ১০ মে নকলা উপজেলার কায়দা গ্রামে জমিসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে ডলি খানম নামে এক অন্ত:স্বত্ত্বা গৃহবধূকে গাছে বেঁধে বর্বরোচিত নির্যাতন এবং ওই নির্যাতনে গৃহবধূর গর্ভের সন্তান নষ্টের ঘটনা ঘটে। ঘটনার এক মাস পর নির্যাতনের একটি ভিডিও ভাইরাল হলে তোলপাড় শুরু হয়। এর প্রেক্ষিতে পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীমের দ্রুত পদক্ষেপে গত ১১ জুন এক সেনা সদস্যসহ ওই গৃহবধূর ৩ ভাসুর ও জাসহ ৯ জনকে স্ব-নামে ও অজ্ঞাতনামা আরও ৩/৪ জনের বিরুদ্ধে থানায় একটি মামলা গ্রহণ করা হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here