শরীয়তপুরে শিক্ষার আলো বঞ্চিত হাজার শিশু

0
277
ভেদরগঞ্জ (শরীয়তপুর) প্রতিনিধিঃ
এই বয়সে তার স্কুলে পড়ার কথা। সহপাঠীদের সঙ্গে খেলাধুলা হৈ চৈ করার সময় তার। মায়ের বকুনি খেয়ে হাসি কিংবা কান্না করার কথা ছিল মেয়েটির। কিন্তু তা না করে সাড়ে ১০ বছরের আশা মনি আক্তার ইটভাটায় কাজ শুরু করেছে। প্রতিদিন এক হাজার ইট টানে সে। বিনিময়ে পায় ১২৫ টাকা।
আশা মনি আক্তারের মতো প্রতিদিন প্রায় ৪০০ শিশু শরীয়তপুরের ইটভাটায় কাজ করছে। অথচ আইন বলছে- ১২ বছরের নিচের কোনো শিশুকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না। কিন্তু শরীয়তপুরে শিশুদের দিয়ে ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করানো হচ্ছে।
কথা হয় আশা মনির সঙ্গে। সে জানায়, লালমনিরহাট থেকে এসে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার মূলনা ইউনিয়নের বোয়ালিয়া ব্রিজ সংলগ্ন লাইখোলা ভান্ডারি ব্রিকস ফিল্ড ইটভাটায় এসেছে। আশা মনি ও তার পরিবারের পাঁচ সদস্য এই ইটভাটায় কাজ করে। প্রতিদিন একটা করে পট (একটি সারি ইট) ওঠায়। সারিতে এক হাজার করে ইট থাকে। এক হাজার ইট ওঠালে ইটভাটার মালিক ১২৫ টাকা করে দেন আশা মনিকে। গরীব হয়ে জন্মেছি তাই ইটভাটায় কাজ করছি- বলে আশা মনি।
আশা মনির ফুফু ফাহিমা বলেন, পেটের দায়ে শরীয়তপুরে এসে ইটভাটায় কাজ করছি। ৪০ হাজার টাকা দাদন নিয়েছি। ৬ মাস এই ইটভাটায় কাজ করব। আমাদের পরিবারের পাঁচজন কাজ করি। প্রতিদিন কাজ করে পাঁচজনে ৫০০ টাকা পাই। সেই টাকা চার ভাগ হয়। আশা মনিকে বাড়িতে একা রেখে আসা যায় না, তাই নিয়ে এসেছি ইটভাটার কাজে।
লাইখোলা ভান্ডারি ব্রিকস ফিল্ড ইটভাটার ম্যানেজার আব্দুল খালেক বলেন, আমরা দাদন দিয়ে লোক আনি। যে লোকগুলো কাজ করে তারা ১০ থেকে ৫০ হাজার টাকা অগ্রিম টাকা নিয়ে ভাটায় কাজ করতে আসে। একজনের ৩ থেকে ৪ জন সন্তান। তাদের বাবা-মা একা কাজ করে খাওয়াবে কী করে? তাই তাদের বাচ্চারা কাজ করে।
শরীয়তপুর জেলা ইট ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি বাবুল বেপারী বলেন, বিভিন্ন জেলা থেকে ৫ থেকে ৬ জনের এক একটি পরিবার আমাদের জেলায় ইটভাটায় কাজ করতে আসে। তাদের সঙ্গে তাদের সন্তানরা থাকে। ওই শিশুরাই মাঝে মধ্যে ইটগুলো তোলে। তবে কোনো শিশুকে দিয়ে ইটভাটায় কাজ করানো হয় না বলে তিনি দাবি করেন।
শরীয়তপুরের ৬টি উপজেলায় মেসার্স কীর্তিনাশা ব্রিকস ফিল্ড, মেসার্স বিশ্বওলী ব্রিকস ম্যানু ফ্যাকচারিং, মেসার্স এইচ.কে. ব্রিকসসহ প্রায় ৫২টি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। এসব ইটভাটায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি ইটভাটায় ১২ বছরের কম বয়সী এমন শিশুরা কাজ করছে। এসব শিশুরা ইট তৈরি ও ইট টানার কাজ করে থাকে। প্রত্যেক শিশু ২০ কেজি ওজনের সমান ছয়খানা কাঁচা ইট মাথায় করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যায়।
জেলার ইটভাটাগুলো ঘুরে জানা যায়, ইটভাটায় কাজ করা শিশুরা অধিকাংশই এসেছে লালমনিরহাট, রংপুর, সাতক্ষীরা, কিশোরগঞ্জ, জামালপুর, বরিশাল ও চাঁদপুর থেকে। এই শিশু শ্রমিকদের অভিভাবকদের অনেককে ভাটার মালিকেরা দাদন দিয়েছেন। শিশুদের বাবা-মা কারখানার মালিকদের কাছ ছয় থেকে আট হাজার টাকা নিয়েছেন। এই টাকা নেয়ার কারণে ইটের কারখানায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে এসব শিশু। এসব শিশু ভাটাতেই ঘুমায়। ভোরে ঘুম থেকে উঠে চলে যায় ইটখোলায়। টানা কাজ করে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। এসব শিশু মূলত কাঁচা ইট মাটি থেকে তুলে ও মাথায় বহন করে। এক হাজার ইট টানলে দেয়া হয় ১২৫ টাকা। অধিকাংশ শিশু প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১ হাজার ইট টানতে পারে।
বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন শরীয়তপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. মাসুদুর রহমান (মাসুদ) বলেন, ইটভাটার মালিকরা বিভিন্ন জেলা থেকে শ্রমিক সংগ্রহ করে তাদেরকে দিয়ে কাজ করান। দুঃখজনক হলেও সত্য এই শ্রমিকদের মধ্যে শিশুরাও রয়েছে। শিশুদের দিয়ে ইটভাটায় কাজ করাচ্ছেন ভাটার মালিকরা। এটা অন্যায়। এ ব্যপারে প্রশাসনের অবশ্যই দৃষ্টি দেয়া উচিৎ।
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের বলেন, আইন অনুযায়ী শিশুদের ইটভাটায় কাজ করানো যাবে না। ইটভাটার মালিকদের নিয়ে আমি অবশ্যই বসব। যদি শিশুদের দিয়ে ইটভাটায় কাজ করানো হয় তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
খবর ৭১/ ই:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here