লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে বিশ্বের ১২৫ দেশে

0
653

খবর৭১ঃনাজমুন নাহার। বাংলাদেশের পতাকাবাহী প্রথম বিশ্ব পর্যটক। দুর্গম পাহাড়, তুষারে আচ্ছন্ন শহর, উত্তপ্ত মরুভূমি, বিশাল সমুদ্র, বিষাক্ত পোকামাকড় কিংবা প্রতিকূল পরিবেশ কোনো কিছুই তার বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সব প্রতিবন্ধকতা জয় করে নাজমুন নাহার ইতোমধ্যেই ভ্রমণ করেছেন বিশ্বের ১২৫ দেশ। বিশ্বজয়ী নাজমুন নাহারকে নিয়ে লিখেছেন-

লক্ষ্মীপুরের সাহসী মেয়ে নাজমুন নাহার। শত বাধা পেরিয়ে লাল-সবুজের পতাকা হাতে ঘুরেছেন ১২৫ দেশ। যেখানেই গিয়েছেন, উড়িয়েছেন লাল-সবুজের পতাকা। দীর্ঘ পথচলায় নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হলেও থেমে যায়নি তার যাত্রাপথ।

প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তিতে ছুটে বেড়িয়েছেন দেশ হতে দেশান্তরে। তার ভ্রমণের তালিকায় রয়েছে- পূর্ব আফ্রিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, পশ্চিম আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকার প্রতিটি দেশ। তিনি সড়কপথে ভ্রমণ করেছেন ইউরোপ ও এশিয়ার বেশিরভাগ দেশ। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে টানা ঘুরেছেন ৩৫ দেশ।

সর্বশেষ ২০১৮ সালে ভ্রমণ করেছেন ৩২ দেশ। আর ২০১৮ নভেম্বর থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ঘুরেছেন পশ্চিম আফ্রিকার ১৫ দেশ। সর্বশেষ ভ্রমণ করেছেন নাইজেরিয়া। নাজমুন নাহারে স্বপ্ন স্বাধীনতার ৫০ বছরপূর্তির বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের মধ্যেই বিশ্বের সব দেশে উড়াতে চান লাল-সবুজের পতাকা।

নাজমুন নাহারের জন্ম ১৯৭৯ সালের ১২ ডিসেম্বর। ছোটবেলা কেটেছে লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার গঙ্গাপুর গ্রামে। বাবা মোহাম্মদ আমিন পেশায় ব্যবসায়ী। বাবার অনুপ্রেরণায় নাজমুন যখন বিশ্বজয়ের নেশায় দেশ থেকে দেশে ছুটে বেড়াচ্ছেন তখন ২০১০ সালে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান তার প্রাণপ্রিয় বাবা। মা তাহেরা আমিন গৃহিণী। তিন ভাই, পাঁচ বোনের মধ্যে নাজমুন নাহার সবার ছোট।

১৯৯৪ সালে স্টার মার্কসহ এসএসসি এবং ১৯৯৬ সালে লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করেন। এরপর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পড়াশোনা শেষে কিছুদিন সাংবাদিকতাও করেছেন।

এরপর ২০০৬ সালে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য সুইডেনে পাড়ি জমান। সেখানে লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এশিয়ান স্টাডিজ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিও অর্জন করেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই নাজমুনের বই পড়ার প্রতি ছিল অকৃত্রিম নেশা। সব ধরনের বই পড়তেন। মাধ্যমিকে পড়ার সময় মাসুদ রানা সিরিজে ছিল অন্যরকম আগ্রহ। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ছোটবেলায় বই পড়ার মাধ্যমেই মূলত দেশ-বিদেশ ভ্রমণের আগ্রহ সৃষ্টি হয়।

পাঠ্যবইয়ের ভ্রমণকাহিনী বা পত্রিকায় প্রকাশিত কোনো ভ্রমণকাহিনী আমাকে বেশ টানত। সৈয়দ মুজতবা আলীসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন লেখকদের ভ্রমণবিষয়ক বইগুলো পড়েছি। ভ্রমণ ব্লগ বা ভিডিও ব্লগগুলো নিয়মিত দেখি। মূলত বই পড়তে পড়তেই হারিয়ে যেতাম অজানা কোনো রাজ্যে, স্বপ্নের কোনো শহরে।

আমার জীবনে দেশ ভ্রমণের অনুপ্রেরণার উৎস আমার পরিবার। বাবা মোহাম্মদ আমিন সবসময় আমার পাশে থাকতেন। কোনো বিষয়ে আমি যদি এক পা এগোতাম বাবা এগিয়ে দিতেন আরও পাঁচ পা। স্কুল জীবনে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হয়ে কাজ করেছি। বাবার প্রেরণা আর সাহসে কৈশোরেই ঘুরে বেড়িয়েছি দেশের বিভিন্ন জায়গা। ভাইবোনরাও সমর্থন দিয়েছেন। কিছু করতে হলে পরিবারের সমর্থন দরকার। আমার পরিবার থেকে আমি সেটা পেয়েছি।

সুইডেনে থাকা অবস্থাতেই বিশ্বজয়ের নেশাটা পেয়ে বসে নাজমুনকে। পড়াশোনার পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজ করতেন। কষ্টার্জিত সেই অর্থের প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেন। নাজমুন নাহার বলেন, আমি শুধু স্বপ্নই দেখতাম না, সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য পরিশ্রম করেছি। নিজের জমানো টাকাতেই ঘুরে বেড়াচ্ছি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।

বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন করার কারণে স্কুল থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছে। তবে বিদেশ ভ্রমণের প্রথম সুযোগ আসে তার ২০০০ সালে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় বাংলাদেশ গার্লস গাইড অ্যাসোসিয়েশনের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য হিসেবে আন্তর্জাতিক অ্যাডভেঞ্চার প্রোগ্রামে অংশ নিতে ভারত যাওয়ার সুযোগ হয় তার। তার নেতৃত্বেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দল ভারতে যায়।

দেশটির মধ্যপ্রদেশের পাঁচমারিতে অনুষ্ঠিত এ গার্লস গাইড আর স্কাউট সম্মেলনে বিশ্বের ৮০টি দেশের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। এভাবেই বিশ্ব ভ্রমণের ফলে অনেক দেশের মানুষের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে। তাদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।

বেশিরভাগ দেশ নাজমুন নাহার একা ভ্রমণ করলেও চৌদ্দটি দেশ ভ্রমণ করেছেন মাকে নিয়ে। বিভিন্ন দেশে থাকার জন্য বেছে নিয়েছেন স্বল্প মূল্যের ইয়ুথ হোস্টেল। সেখানে তার পরিচিত হওয়ার সুযোগ হয় বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের সঙ্গে।

কখনও তাদের দলে ভিড়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন জানা-অজানা পথে। নাজমুন নাহারের মতে, একা ঘুরলেও খারাপ লাগেনি। সবসময় নতুন কিছু জানার আগ্রহ আমাকে তাড়িয়ে বেড়াত। নতুন জায়গা জানার পাশাপাশি সেখানকার মানুষকেও জানান সুযোগ হয়।

নতুন নতুন বন্ধু তৈরি হয়। মায়ের কাছে ভ্রমণের রোমাঞ্চকর অনুভূতি প্রকাশ করতেন। তার মা বেশ উৎসাহের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় জানতে চাইতেন। এরপর মাকে নিয়ে ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতমালা থেকে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেড়ান তিনি।

একজন বাংলাদেশি নারী হিসেবে দীর্ঘ ভ্রমণে নাজমুন নাহার কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হননি। তার মতে, নারীর প্রতিবন্ধকতা মূলত একটা মানসিক সংগ্রাম, একটা সামাজিক ভীতি। এ ভয়কে জয় করতে পারলে সবকিছুই সহজ হয়ে যায়।

সাহস আর আত্মবিশ্বাসের কারণে কোনো অসুবিধা হয়নি। অভিযাত্রায় নানা প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন; কিন্তু তা একজন নারী হিসেবে নয়! একজন বিশ্ব অভিযাত্রী হিসেবে!

তিনি মনে করেন, জীবনের কোনো প্রতিবন্ধকতাই বড় কোনো সমস্যা নয়। যদি সব কঠিনকে মোকাবেলা করার মানসিক শক্তি থাকে! জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল মানসিক চ্যালেঞ্জ! যা অতিক্রম করতে পারলেই জীবনের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারা সম্ভব! প্রতিবন্ধকতা যে কারোরই সামনে আসতে পারে। তাতে পিছিয়ে গেলে চলবে না, ভয়কে জয় করে এগিয়ে যেতে হবে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে।

বিশ্বের নারীরা তাকে নানাভাবে উৎসাহিত করেছেন। নাজমুন নাহারকে দেখেও তারা উৎসাহিত হয়েছেন! আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নারীরা পরিবারের প্রধান নীতিনির্ধারণীর দায়িত্ব পালন করেন। শুধু তাই নয়, তারা পেছনে বাচ্চা, মাথায় তরকারির ঝুড়ি নিয়ে বাইক চালান। অনেক মেয়ে বোরখা পরেও বাইক চালান। জীবনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তা করতে নারীরা থেমে নেই। বিশ্বের নারীরা অনেক স্বাধীনচেতা, ছেলেমেয়ের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতেও বিভিন্ন প্রতিকূলতা জয় করতে হয়েছে নাজমুন নাহারকে। ১৪ হাজার ২০০ ফুট উচ্চতায় পেরুর রেইনবো মাউন্টেন অভিযাত্রায় আল্টিটিউড সমস্যায় মৃত্যুর দুয়ার থেকে কোনো রকমে বেঁচে যান তিনি। অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের সমুদ্রে

স্নোর্কেলিংয়ের সময় মুখ থেকে ছিঁড়ে গিয়েছিল পাইপ। অনেক সময় সমুদ্রের লবণাক্ত পানি মুখে ঢুকে পড়েছে। কিউবায়তো আখের রস খেয়েই কাটাতে হয়েছে দিনের পর দিন। আমেরিকার জঙ্গলে প্রচণ্ড শীতের মধ্যে তাঁবুতে ঘুমানো, আইসল্যান্ডের ল্যান্ড মান্নালুগারের উঁচু পাথরের উপত্যকায় হারিয়ে যাওয়া, বলিভিয়ার দ্বীপে পথ হারানো কিংবা ইন্দোনেশিয়ার ইজেন কার্টারে ভয়ংকর ভলকানিক অভিযানে যাওয়ার মতো দুঃসাহসিক অভিজ্ঞতাও রয়েছে তার।

দেশকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন নাজমুন নাহার। এত দেশ ঘুরেও বাংলাদেশেই ফিরে আসেন বারবার। বাংলাদেশের বাইরের দেশগুলোর মধ্যে আইসল্যান্ডই সেরা তার চোখে। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, জাম্বিয়ার ভিক্টোরিয়া জলপ্রপাত, দক্ষিণ ইথিওপিয়ার কনসো, কেনিয়ার লেক নাকুরু, রুয়ান্ডার কিগালি শহর, দক্ষিণ আফ্রিকার ওয়াইল্ড নেচার, কিউবার হাভানা শহরের দেয়ালে দেয়ালে চমৎকার সব গ্রাফিতি, আর্জেন্টিনার আন্দেস্।

মাউন্টেন, ব্রাজিলের ফোজ ডু ইগুয়াচু জলপ্রপাত, পেরুর মাচ্চুপিচ্চু, সুইজারল্যান্ডের আল্?প্স পর্বতমালা, অস্ট্রেলিয়ার হ্যাভেন বিচ, নিউজিল্যান্ডের মাউন্ট কুক, গ্রিসের সান্তোরিনি আইল্যান্ড, স্পেনের পালমা থেকে ভ্যালেন্সিয়া যাত্রা, ইতালির রোম শহরের সৌন্দর্য, আবুধাবির শেখ জায়েদ মসজিদ আমাকে টানে।

পৃথিবীর যেখানেই যান নাজমুন নাহার, সঙ্গে থাকে বাংলাদেশের পতাকা। লাল-সবুজের পতাকা বহনের জন্য জাম্বিয়া সরকারের একজন গভর্নর তাকে ‘ফ্ল্যাগ গাল’ খেতাব দিয়েছেন। সম্প্রতি আলোকিত নারী, ‘অনন্যা সম্মাননা’ পুরস্কার অর্জন করেছেন নাজমুন নাহার।

খবর৭১/ইঃ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here