লালমনিরহাটে মুক্তিযোদ্ধা প্রতাপ মসলার ফেরিওয়ালা

0
352

আসাদুল ইসলাম সবুজ, লালমনিরহাট : দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করা মুক্তিযোদ্ধা প্রতাপ চন্দ্র রায় একমুঠো ভাতের জন্য স্বাধীন দেশে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে ফেরি করে গরম মসলা বিক্রি করছেন। শুধু টাকা নয়, ধান চালের বিনিময়ে মসলা কিনতে পেয়ে গ্রামীন নারীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় প্রতাপের গরম মসলা। প্রতাপ চন্দ্র রায় লালমনিরহাট সদর উপজেলার হারাটি ইউনিয়নের কাজিচওড়া গ্রামের বাসিন্দা। ভুমিহীন এ মুক্তিযোদ্ধা ওই গ্রামের মৃত নেপাল চন্দ্রের বসত বাড়িতে শৈশব থেকেই আশ্রিত থাকেন। তিনি রংপুরের গংগাচওড়া উপজেলার মন্বেয়ার চর গ্রামের মৃত তারিনী চন্দ্রের ছেলে।
মুক্তিযোদ্ধা প্রতাপ চন্দ্র রায় জানান, জন্মের ৬/৭ বছরের মাথায় বাবা মাকে হারান তিনি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস মায়ের মৃত্যুর পরে তিস্তার হিং¯্রাে ¯্রােতে ভেসে যায় তার বসত ঘর। এরপর বাজারে ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়ানো এতিম প্রতাপকে নিয়ে যান লালমনিরহাট সদর উপজেলার কাজিরচওড়া গ্রামের নেপাল চন্দ্র। সেখানেই আজ অবধি রয়েছেন প্রতাপ চন্দ্র রায়।
যুদ্ধের ভয়াল স্মৃতি চারনে প্রতাপ চন্দ্র জানান, ১৯৭১ সালের ভয়াল দিনে তিনি ৮ম শ্রেনীর ছাত্র। গ্রামের অনেক বাড়ি পুড়ে দেয়া হয়, পাখির মত গ্রামের নিরস্ত্র মানুষের বুকে গুলি চলায়। মায়েদের গুলি করে যুবতী বোনদের টেনে হেচড়ে নিয়ে নির্যাতন চালিয়েছে পাকিস্তানী হায়েনার দল। এসব দেখে টগবগে যুবক প্রতাপ দেশের জন্য ছুটে যান ভারতের প্রশিক্ষণ শিবিরে। সেখানে অস্ত্র চালানো ও যুদ্ধের কৌশল আয়ত্ব করে দেশমাতৃকার মুক্তির নেশায় যুক্ত হন ৭ নং সেক্টরে। সেখানে সেক্টর কমান্ডার নজরুল ইসলাম হাজীর নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন প্রতাপ। দেশের অভ্যন্তরে দুই মাস যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন তিনি। এরপর দেশ হানাদার মুক্ত হয়। পতপত করে মুক্ত আকাশে উড়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা।
দেশ স্বাধীনের পর ছুটে আসেন বিপদের আশ্রয় দাতা পিতৃতুল্য সেই নেপাল চন্দ্রের কাছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত সেই নেপালের সব কিছু ছাই করে দিয়েছে পাকিস্তানের দালাল আল বদর আল সামসের গোষ্ঠীরা। মেরে ফেলেছে গ্রামের অনেক আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুদের। পুরো গ্রাম জুড়ে ছিল পঁচা লাশ ও আগুনে পুড়ে যাওয়ার বিশ্রী গন্ধ।
বেঁচে থাকার তাগিদে ফেরিওয়ালা হিসেবে স্বাধীন দেশে জিবিকার পথ খুঁজে পান মুক্তিযোদ্ধা প্রতাপ চন্দ্র রায়। আশ্রিত হলেও নিজের সন্তানের মতই প্রতাপের বিয়ে আয়োজন করেন নেপাল চন্দ্র। পাশ্ববর্তি বেমালা দেবীকে মালা পড়িয়ে স্ত্রী হিসেবে ঘরে তুলেন প্রতাপ চন্দ্র রায়। নেপালের মৃত্যুর পর এক ছেলে এক মেয়ে ও স্ত্রীসহ তার সংসারের দায়িত্ব চেপে বসে প্রতাপ চন্দ্রের কাঁধে। ভাইয়ের ভালবাসায় পিতৃস্নেহে বড় করেছেন নেপালের ছেলে অশোক কুমারকে। তার নিজের সংসারে আসা তিন সন্তানের বিয়ে দিয়েছেন। এখন দুই ভাই ফেরি ও দিন মজুরী দিয়ে চলে তাদের সংসার। দুঃখে যাদের জিবন গড়া তাদের আবার দুঃখ কি? যোগ করেন রসিক প্রতাপ চন্দ্র রায়।
সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা দিচ্ছে শুনে কাগজ পত্র নিয়ে দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতাদের দুয়ারে দুয়ারে নিস্ফল ঘুরছেন প্রতাপ চন্দ্র রায়। সবাই ভোটের সময় কথা দিয়ে ভোট নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নেতা হন। কিন্তু কেউ তাকে ভাতার ব্যবস্থা করেননি। সম্মানী এ ভাতার জন্য গত বছর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা বাছাই কমিটিতে আবেদন করেছেন প্রতাপ। কিন্তু কোন কাজে আসেনি বলে জানান তিনি। দেখতে চাইলে অনায়সে তুলে দেন মুক্তিযোদ্ধার প্রমানপত্র। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার যথেষ্ট প্রমান রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ের লাল মুক্তিবার্তা মতে তার ক্রমিক নং ৩১৪০১০৪৩৬। ২০০৫ সালের ৩০ মে তারিখের প্রকাশিত বেসামরিক গেজেটের ৫১৪৫ নং পৃষ্ঠার ৪৯৭ নম্বরের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রয়েছেন প্রতাপ চন্দ্র রায়। লালমনিরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ৩৩৪ নং ভোটার তিনি। সবদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি রয়েছে তার। নেই শুধু সরকারী সম্মানী ভাতাটুকু। মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচনে ভোট ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে সংবর্দ্ধনা দেয়া হলেও সরকারের সম্মানী ভাতা থেকে বি ত রয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা প্রতাপ চন্দ্র রায়। ৭১ সালে তরতাজা যুবক পরাক্রমশালী প্রতাপ চন্দ্র মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ করলেও জিবনের শেষ সময়ে নাজুক প্রতাপ স্বাধীন দেশে জিবন সংগ্রামে হারতে বসেছেন। ফেরি করে আয় হলে পেটে ভাত, নতুবা অভুক্ত থাকতে হয় তাদের যোগ করেন প্রতাপ চন্দ্র রায়।
প্রতাপ চন্দ্র রায় বলেন, পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে খেয়ে না খেয়ে যুদ্ধ করে মরিনি। দেশ স্বাধীন করেছি। স্বাধীন দেশেও না খেয়ে মরব না। কিন্তু মৃত্যুর পর স্ত্রীর জন্য এ সম্মানী ভাটা খুবই প্রয়োজন। যখন কাজে অক্ষম হব বা মারা যাব তখন কে দেখবে তার স্ত্রী বেমালা দেবীকে। এ ব্যাপারে হারাটি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রফিক জানান, প্রতাপ চন্দ্র রায় একজন মুক্তিযোদ্ধা। ভাতা না পাওয়ার কারন তার জানা নেই। তবে তাকে ভাতার আওতায় আনা খুবই প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here