রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে

0
266

খবর৭১ঃইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেডক্রস (আইসিআরসি) হেড অব ডেলিগেশন ইখতিয়ার আস্লানোভ বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ অব্যাহত রয়েছে।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে আমাদের উদ্বেগ রয়েছে। কেননা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হল এ সংকটের টেকসই সমাধানের অন্যতম। রাখাইনে তাদের ফিরে যাওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ চাই।

তিনি মঙ্গলবার ঢাকায় আইসিআরসি কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এ কথা বলেন। ইখতিয়ার আস্লানোভ বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য রাখাইন রাজ্যে ঘরবাড়ি নির্মাণই যথেষ্ট নয়।

তাদের জন্য ঘরবাড়ি নির্মাণ করা ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও আরও অনেক কিছু করার বাকি রয়েছে। রোহিঙ্গাদের স্মৃতিতে এখনও সেখানকার ঘটনার কথা রয়েছে। রোহিঙ্গা সংকটের সঙ্গে মুসলমান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত ইস্যু রয়েছে। কিছু কিছু উন্নয়ন ইস্যুও রয়েছে।

রাখাইন রাজ্য মিয়ানমারের মধ্যে সবচেয়ে অনগ্রসর অঞ্চল। তিনি বলেন, রাখাইনের পরিস্থিতির প্রতি তাদের নজর রয়েছে। যদিও মানবিক সহায়তা সংস্থা হিসেবে রাজনৈতিক সমাধানের কোনো কিছু তাদের হাতে নেই।

এ সীমাবদ্ধতার মধ্যে তাদের কাজ করতে হয়। আইসিআরসি একমাত্র আন্তর্জাতিক সংস্থা যাদের উপস্থিতি রাখাইনে রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের কিছুটা হলেও ক্ষুদ্র অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার সুপারিশ করেন তিনি। ইখতিয়ার আস্লানোভ বলেন, বিষয়টি একান্তই বাংলাদেশের নিজস্ব সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। তবে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদে সাহায্যের ওপর পরিচালনা সম্ভব নয়।

সাহায্যের প্রবাহ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার উদ্বেগের বিষয় বিবেচনায় রেখেই সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন, এটা খুবই স্বাভাবিক। তিনি স্বীকার করেন, স্থানীয় মানুষের ওপর রোহিঙ্গাদের অবস্থান ব্যাপক চাপের সৃষ্টি করেছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাখাইনে আইসিআরসিকে কাজ করার অনুমতি দেয়ায় মিয়ানমার এ ইস্যুতে কিছুটা উন্মুক্ত নীতি নিয়েছে। কিন্তু এতে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এমন নয়। কারণ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয় তাড়াতাড়ি।

কিন্তু নিজের ঘরবাড়িতে ফিরে যাওয়া এত তাড়াতাড়ি হয় না। প্রত্যাবাসন কাজ অনেক সময় নিয়ে হয়ে থাকে। এটা একটা রাজনৈতিক সংকট। রাজনৈতিক সমাধান কোনো মানবিক সংস্থার হাতে নেই। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দীর্ঘ সময় নেবে।

ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের পাঠানোর সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা বাংলাদেশের সার্বভৌম সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে আমরা সরকারের এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখার আবেদন করি। সরকার যেন মানবিক দিক মনে রাখে। বিশেষ করে জলোচ্ছ্বাস, ঝড়, বিদ্যুতের সুবিধা, পানি সরবরাহসহ অপরাপর সেবাগুলো নিশ্চিত হয়েছে কিনা।

রোহিঙ্গাদের ক্যাম্প থেকে বাইরে ছড়িয়ে যাওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ছড়িয়ে যাওয়া শুধু বাংলাদেশেই নয়। যেখানেই এ ধরনের সমস্যা আছে; সবখানেই এ সমস্যা হয়। ইখতিয়ার বলেন, আমরা প্রথমে বুঝতেই পারিনি যে সমস্যা এত বড় হবে। তবে সংকট নিরসনে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করতে বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয়ভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এটা ইতিবাচক পদক্ষেপ।

‘ইস্যুটি আঞ্চলিক সংকটে রূপ নিচ্ছে’ : রোহিঙ্গা ইস্যুটি আঞ্চলিক সংকটে রূপ নিতে চলেছে। এ অঞ্চলের রাজনীতি, অর্থনীতি ও নিরাপত্তায় এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। তবে কৌশলত দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে মিয়ানমার।

প্রতিবেশী বড় দুই দেশ ভারত ও চীন তাদের পক্ষে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো সম্পর্ক না থাকায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলোও দেশটির বিরুদ্ধে শক্ত কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। আর এর সুযোগ নিচ্ছে দেশটি।

বিশ্বনেতাদের বুঝতে হবে, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ নয়, মিয়ানমারের নাগরিক। আর তাদের নিরাপদে ফেরাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। মঙ্গলবার রাজধানীর একটি হোটেলে আলোচনা সভায় মিয়ানমারে নিয়োজিত কানাডা সরকারের বিশেষ দূত বব রে এসব কথা বলেন। ঢাকাস্থ কানাডিয়ান হাইকমিশন আলোচনা সভার আয়োজন করে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

ইন্সটিটিউট ফর পলিসি অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সৈয়দ মুনীর খসরুর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচক ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির, মেজর জেনারেল (অব.) এএনএম মুনিরুজ্জামান, সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম. সাখাওয়াত হোসেন ও আইনজীবী রাজা দেবাশীষ রায়।

এ সময় রোহিঙ্গা হত্যায় দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান বক্তারা। তাদের মতে, মিয়ানমারে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমছে।

বব রে বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকট তৈরি করেছে। তবে এ সমস্যা এক দিনের নয়। এর বিভিন্ন জটিল দিক রয়েছে। প্রাকৃতিক ও খনিজসম্পদ-সমৃদ্ধ ভূমি দেশটির ক্ষমতার প্রধান অংশীদার সেনাবাহিনী। আন্তর্জাতিক স্বার্থগোষ্ঠীর রয়েছে বহুমুখী প্রতিযোগিতা ও স্বার্থ। এ ছাড়াও ঐতিহাসিক, ভৌগোলিক ও আদর্শগত দ্বন্দ্বের ফলাফল এটি।

কর্তৃত্ববাদী শাসন, ধর্মীয় নিধন ও প্রাকৃতিক সম্পদ এ সংকটের বিভিন্ন প্রবণতা তৈরি করেছে। তিনি বলেন, বিশ্ব সম্প্রদায়কে বুঝতে হবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নয়, মিয়ানমারের নাগরিক। তাদের সেখানে ফিরতেই হবে। তবে তাদের নিরাপদ, টেকসই ও স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তনের সুযোগ নিশ্চিত করা জরুরি।

তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুটি একটি আঞ্চলিক সংকটে রূপ নিচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এ অঞ্চলের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক ও নিরাপত্তায় এর প্রভাব পড়বে। তিনি আরও বলেন, এ অবস্থায় রোহিঙ্গাদের নিরাপদে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। বিশ্ব সম্প্রদায়কে বুঝতে হবে, তারা যেটি করছেন তা উন্নয়ন সহযোগিতা নয়, এটি মানবিক সহযোগিতা।

বব রে বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী যে নির্যাতন করেছে, তা মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে অগ্রগতি রয়েছে। দুই দেশের প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়েছে। এ ছাড়াও সীমান্ত নিরাপত্তা চুক্তি হয়েছে। এর ফলে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়ন হচ্ছে। এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, অতীতে আমরা মিয়ানমারের দিকে বিশেষ নজর দেইনি।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য পাঁচ-দশ বছরও লেগে যেতে পারে। যেহেতেু এটি একটি আঞ্চলিক সংকট, ফলে তা নিরসনের ক্ষেত্রে একমাত্র চীনই আমাদের সহায়তা করতে পারে। চীনের সঙ্গে সরাসরি কূটনৈতিক সহায়তায় তা সম্ভব না হলে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর যেমন জাপান, কিংবা আশিয়ানের সদস্য রাষ্ট্রের সাহায্যে তা করতে হবে।

মেজর জেনারেল (অব.) এএনএম মুনিরুজ্জামান বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুর এক বছর পার হয়েছে, কিন্তু সমাধানের পথে আমরা বিশেষ এগোতে পারিনি। রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা আমাদের জন্য নিরাপত্তা সংকট তৈরি করছে।
খবর৭১/এসঃ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here