রানার এখন নেপালে

0
452

খবর৭১:‘রানার চলেছে, রানার! রাত্রির পথে পথে চলে কোনো নিষেধ জানে না মানার। দিগন্ত থেকে দিগন্তে ছোটে রানার- কাজ নিয়েছে সে নতুন খবর আনার।

সুকান্ত ভট্টাচার্যর লেখা ‘রানার’ কবিতার শ্রমজীবী মানুষটির মতোই নিভৃতে পথ চলে দেশের ‘রানার অটোমোবাইল’ ময়মনসিংহের ভালুকার কারখানা থেকে বেরিয়ে এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নেপালের চড়াই-উতরাই পথ। তৈরি পোশাক, চিংড়ি, চামড়াজাত দ্রব্যসহ অনেক পণ্যই বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে। ২০১৭ সালে এসে তালিকায় নাম লেখাল মোটরসাইকেল। গত ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবসের সন্ধ্যায় ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ লেখা মোটরসাইকেল মঞ্চ কাঁপাল কাঠমাণ্ডুর একটি অভিজাত হোটেলে। ৮০ থেকে ১৫০ সিসির সাত মডেলের মোটরসাইকেল নিয়ে একে একে মঞ্চে ওঠেন নেপালের সাত তরুণ।

রানার ব্র্যান্ডের সাতটি মডেলের মোটরবাইক মিলছে নেপালে, এর মধ্যে নাইট রাইডার, কাইট প্লাস ব্যবহারকারীদের মধ্যে আশাতীত সাড়া ফেলেছে। গত ২১ জানুয়ারি বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি শুরুর পর কয়েকটি চালানে এ পর্যন্ত পাঠানো হয়েছে ৪০০ মোটরসাইকেল।

১৬ ডিসেম্বর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মাসফি বিনতে সামস, রানার গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান খান, রানার অটোমোবাইলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুকেশ শর্মা, রমন মোটরসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রমন মেহতাসহ প্রতিষ্ঠান দুটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। রাজধানী শহরের তারকা হোটেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি ছিল আড়ম্বরপূর্ণ।

নেপালি ভাষায় ফেস্টুনে, ব্যানারে লেখা হয় ‘রানার সব সবকে সারথী’। হিন্দি গানের টিভিসিতে দেখা যায়, রানার মোটরসাইকেলে করে চষে বেড়াচ্ছেন বাংলাদেশের তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। নেপালি রাজপথে রানার চলছে, নেপথ্যে গান বাজছে ‘গাঁও শহর মে গুজারতা হে…। ‘ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘আজকের সন্ধ্যাটি দুই কারণে বিশেষ। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস। এই দিনেই বাংলাদেশের একটি পণ্যের বিক্রি আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হচ্ছে বাইরের একটি দেশে। ‘ রানার গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান খান বলেন, ‘নেপালের বাজার আমাদের জন্য খুবই গর্বের। নেপালের মাধ্যমেই প্রথম বাংলাদেশি ব্র্যান্ড হিসেবে রানার মোটরসাইকেল রপ্তানি শুরু করেছি। ‘

নেপালি কম্পানি রমন মোটরসকে সে দেশে বিক্রেতা হিসেবে নিযুক্ত করেছে রানার অটোমোবাইলস। গত ১৭ ডিসেম্বর কাঠমাণ্ডুর ব্যস্ত সড়ক রিংরোডের পাশে তৈরি রানার মোটরসাইকেলের শো রুম উদ্বোধন করেন রানারের সাফল্যের নায়ক হাফিজুর রহমান খান। বাংলাদেশের মোটরসাইকেল বিক্রি নিয়ে অনেক উচ্চাশা নেপালি প্রতিষ্ঠান রমন মোটরসের। তারা ইতিমধ্যেই নেপালে ১০ ডিলার নিয়োগ দিয়েছে। সামনের ছয় মাসে আরো ২০টি শো রুম এবং সে অনুযায়ী সার্ভিস সেন্টার গড়ার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। নেপালের মোটরসাইকেলের বাজার ভারতের, সঙ্গে আছে চীন।

গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় রানার কার্যালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্বোধন-উত্তর সাক্ষাৎকার দেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার। ‘আমার স্বপ্ন লোকালের চেয়ে বেশি এক্সপোর্ট করা’ বলছিলেন হাফিজুর রহমান খান। তিনি বলেন, দেশের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায়ই বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্য হিসেবে মোটরসাইকেল এখন রপ্তানি হচ্ছে। কাঠমাণ্ডুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি জানিয়েছিলেন, নেপালের পর আফ্রিকার বাজারেও রানার যাবে- এ নিয়ে কাজ চলছে; গতকালও তিনি এই পরিকল্পনার পুনুরুল্লেখ করেন। বাংলাদেশে বছরে সব প্রতিষ্ঠানের মিলে সাড়ে তিন লাখ মোটরসাইকেল বিক্রি হয় জানিয়ে তিনি বলেন, এর একটি বড় অংশ বিদেশ থেকে আসছে। ‘আপনাদের সক্ষমতা কত’- এমন প্রশ্নে তাঁর উত্তর : ‘এক শিফটে ৫০০ মোটরসাইকেল উৎপাদনের সক্ষমতা আছে আমাদের। ‘

দুই চাকায় ভর করে রানার ইতিমধ্যেই ছড়িয়েছে সারা বাংলাদেশে। ২০০ এর মতো ডিলার রয়েছে তাদের, সার্ভিস সেন্টার আরো বেশি- তিন শত। রানার নিজেরা বহু মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা যেমন করেছে, তাদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বিকশিত হচ্ছে বিভিন্ন ‘ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান’। সেখানেও বাড়ছে কর্মসংস্থান। চারটি প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে সিট, চেইন, ইনডেকর লাইট ও প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরি করে দিচ্ছে রানার অটোমোবাইলসকে।

রানারের যাত্রা শুরু ২০০০ সালে, মোটরসাইকেল আমদানির মধ্য দিয়ে। এখন ময়মনসিংহের ভালুকায় রানারের রয়েছে ৪০ একর জমির ওপর তৈরি উৎপাদনকেন্দ্র। ২০০৭ সালে প্রথম মোটরসাইকেলের খুচরা সামগ্রী তৈরির মাধ্যমে স্থানীয়ভাবে মোটরসাইকেল উৎপাদন শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১১ সালে রানার পানচিং, ওয়েল্ডিং, পেইন্টিং, অ্যাসেম্বলিং, টেস্টিংসহ আনুষ্ঠানিক যন্ত্রপাতি স্থাপনের মাধ্যমে মোটরসাইকেল উৎপাদনকারী হিসেবে সরকারি অনুমোদন লাভ করে। পূর্ণাঙ্গ মোটরসাইকেল কারখানা হিসেবে পুরোদমে উৎপাদনে যায় ২০১২ সালে।

সুকান্ত লিখেছেন, ‘রানার চলেছে, বুঝি ভোর হয় হয়, আরো জোরে, আরো জোরে হে রানার দুর্বার দুর্জয়’। রানার গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান খানেরও বিশ্বাস তাঁদের পথচলা সবে শুরু হয়েছে। রানার মোটরসাইকেল একদিন আফ্রিকা অঞ্চলসহ আরো অনেক ভূখণ্ডে যাবে। প্রতিষ্ঠানটির ওপর এ আস্থা রয়েছে সরকারি পর্যায়েও। গত ২১ জানুয়ারি ভালুকায় রপ্তানি কার্যক্রম উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। এ সময় তিনি বলেন, ‘এই কারখানা ঘুরে মনে হয়েছে বাঙালি জাতি সব কিছুই পারে। হাফিজুর রহমান খান প্রমাণ করেছেন তিনি সত্যিই একজন প্রতিভাবান উদ্যোক্তা। রানার অটোমোবাইলসের কারখানা দেখে আমি সত্যিই অভিভূত, মুগ্ধ। দেশ কত উন্নতি করেছে তা রানারের এই রপ্তানির মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে। ‘ মন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমাদের পোশাক রপ্তানিতেই সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। অন্যান্য অপ্রচলিত পণ্যের দিকেও নজর দিতে হবে। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের মাত্র ২৫টি পণ্য বিশ্বের ৬৮টি দেশে রপ্তানি হতো। আজ সেই বাংলাদেশ ১৯৬টি দেশে ৭২৯টি পণ্য রপ্তানি করছে। এখন আমরা মোটরসাইকেল রপ্তানিতেও সক্ষম হয়েছি। ‘
খবর৭১/জি:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here