মিস্টার বিড়ালের বাংলাদেশ এবং অনুচ্চারিত খবিশ ও রাবিশ

0
543
মিস্টার বিড়ালের বাংলাদেশ এবং অনুচ্চারিত খবিশ ও রাবিশ
ডাঃ মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল, চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও অর্থ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।

খবর৭১ঃ মিস্টার বিড়াল প্রতিযোগিতা চলছে। সাড়া দুনিয়া থেকে তাবত নামী-দামী বিড়ালরা অংশ নিচ্ছে। প্রতিযোগিতার ফল ঘোষিত হতেই সবাই ভীষণ অবাক। এবারের মিস্টার বিড়াল খেতাবটা জিতে নিয়েছে বাংলাদেশের একটি বিড়াল। শুধু বন্যা, দুর্ভিক্ষ আর হানাহানির জন্য আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় শিরোনাম হয় যে দেশটি, সেই তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশের বিড়ালের অমন কৃতিত্বে তাজ্জব সবাই। গলায় মেডেল ঝুলিয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত বাংলাদেশের বিড়াল। এক ব্রিটিশ সাংবাদিক জানতে চাইলেন তার এই সাফল্যের রহস্য। কেমন করে, কিভাবে তিনি বাংলাদেশের বিড়াল হয়েও আজকের এই জায়গায় এসে পৌঁছালেন। বিড়ালের উত্তর শুনে সবার আরেকবার ভিরমি খাবার যোগার। ‘আরে আমি তো সুন্দর বনের বাঘ, না খেতে খেতে আমার এই বিড়াল দশা’-মুচকি হেসে উত্তর দিল সদ্য খেতাব জয়ী মিস্টার বিড়াল।

একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশ আর দেশটার সব কিছুকে নিয়েই এমনি নানা রসিকতা আর তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা। এমনি হাজারো রসিকতার পাত্র হয়েই আমাদের প্রজন্ম শৈশব থেকে যৌবন পেরিয়ে মধ্যবয়সে এসে পৌঁছেছি। বাংলাদেশের আজকের বাস্তবতায় অবশ্য মিস্টার বিড়ালের কেচ্ছার কোন স্থান নেই। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম মিস্টার বিড়ালের বাংলাদেশকে চেনে না। এদেশের ভোকাবুলারি থেকে অনেক শব্দই বিলুপ্ত হতে বসেছে। মঙ্গা কাকে বলে, এটি কত প্রকার ও কি কি এসব আমার সুকন্যা-সূর্য্যর অচেনা। এখন ঢাকা থেকে প্রতিদিন সৈদয়পুরে আসা-যাওয়া করে দশটিরও বেশি বিমান আর এর প্রতিটি থাকে পরিপূর্ণ।

তবে একদল মানুষ রয়ে গেছে যাদের কাছে মিস্টার বিড়ালের বাংলাদেশটাই খুব প্রিয়। সুন্দরবনের বাঘ দাঁপিয়ে বেড়াক গোটা বিশ্ব, এমন দৃশ্য তাদের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আর বাঘকে বিড়াল বানিয়ে রাখায় এদের চেষ্টারও কোন শেষ নেই। এর জন্য এরা যা খুশি করতে পারে, ঘটাতে পারে যে কোন অঘটনও। এদের পূর্বসূরিদের হাতেই একদিন সপরিবারে নিহত হয়েছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তারও আগে একাত্তরের ৯টি মাসে এরাই পাকিস্তানীদের সঙ্গে হাতে হাত আর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মেতেছিল বাঙালী নিধন আর ধর্ষণের উৎসবে। হালে একুশে আগস্ট এদেরকেই আমরা দেখেছি বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার আর তার হাতে গড়া বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার লক্ষ্যে গ্রেনেড বিস্ফোরণের মহোৎসব ঘটাতে। এরাই একদিন হলি আর্টিজানে রক্তস্রোত বইয়েছিল। আর এরাই আবার নাসিরনগর আর বোরহানউদ্দিন কারে জন্ম দেয়। এরা কখনও চাঁদে সাঈদীকে দেখে তো কখনও কাদের মোল্লাকে শহীদ বানিয়ে পত্রিকার শিরোনাম হয়। আমাদের দুর্ভাগ্য, স্বাধীন বাংলাদেশের এই যে প্রায় পঞ্চাশ বছরের পথচলা, এর অধিকাংশ সময়ই এরাই নামে-বেনামে, বেশে-ছদ্দবেশে এদেশে ক্ষমতায় ছিল। আজ যারা টানা এগারো বছরের আওয়ামী শাসনে হাঁপিয়ে উঠছেন, এরা তারাই। কারণ বাংলাদেশের আটচল্লিশ বছরে ক্ষমতার মসনদে তাদের কেটেছে আঠাশ বছরেরও বেশি। ইদানীং অবশ্য এদের পিঠ ক্রমশই দেয়ালে ঠেকে যাচ্ছে। একে তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নের মহাযজ্ঞ আর অন্যদিকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় তার উদ্যোগে এরা দিশেহারা। উন্নয়নের অনুষঙ্গ হিসেবে তৃতীয় বিশ্বে দুর্নীতি আর বিচারহীনতা পাশাপাশি হাটে, যার ব্যতিক্রম হয়নি এদেশেও। এই যে আমাদের আজকের উন্নয়নযজ্ঞ, তার স্থায়িত্ব নিয়ে যখন সংশয়ে দেশের সুশীল সমাজ আর এমনকি সাধারণ মানুষও, দুর্র্নীতির ইঁদুর না খেয়ে যায় সাফল্যের সব গুড়, এমনি দোলাচালে যখন দেশের অনেকেই, তখনই স্বস্তির বাতায়নটা আরও একবার তৈরি করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঘরের ভেতরে ঘাপটি মেরে থাকা অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে এসে তিনি সরকারী দলের পরিবেশটাও অপরাধীদের জন্য অনিরাপদ করে তুলেছেন। তিনি যেমন একদিন বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী আর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার অসম্ভবটাকে সম্ভব করেছিলেন, আজ তিনি আরও একবার আরও একটি অসম্ভবকে সম্ভব করার মিশনে নিয়োজিত।

সঙ্গত কারণেই মিস্টার বিড়ালের বাংলাদেশের ভক্তকুল ইদানীং খুব বেশি অশান্তিতে আছে। দেশে-বিদেশে তাদের কর্মকান্ডে এটা প্রায়ই প্রতিভাত। বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখে এরা এতদিন ভেবেছিল এ বুঝি টেকসই হবে না। এখন তাদের সেই স্বস্তিটুকুও কর্পূরের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। এদের কাজে-কথায় তাই অনেক অসংলগ্নতা। কখনও কখনও যা শিষ্টাচারের সীমাও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এক ব্রিটিশ সাংসদের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্য ফেসবুকের কল্যাণে আমার মতো আরও অনেকেরই চোখে পড়েছে। সঙ্গত কারণেই এর প্রতিবাদ করেছেন তারা। আমার কিন্তু বেচারির জন্য করুণাই হয়েছে। ব্রিটেনের কেন, পৃথিবীর কোন দেশেই সাংসদ হওয়া তো চাট্টিখানি কথা নয়। বিচার-বুদ্ধি যথেষ্ট থাকা চাই নিশ্চয়ই। অথচ লন্ডনে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এই সাংসদ বাংলাদেশকে আখ্যায়িত করেছেন দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হিসাবে। পরিচয় দিয়েছেন চরম বুদ্ধিহীনতার। ভদ্রমহিলা তার বক্তব্যে আমাদের সংবিধানের চার মূলনীতিকেও টেনে এনেছেন। তার ভাষায় ধর্মনিরপেক্ষতা নাকি এখন এদেশে কর্তৃত্বপরায়ণ সরকারের যাঁতাকলে পর্যদুস্ত। কি হাস্যকর যুক্তি? বেচারি ভুলে গেছেন যে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে আমাদের সংবিধানের চারটি স্তম্ভের অন্যতম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মাঝে বিএনপি-জাতীয় পার্টির ‘পেয়ারে পাকিস্তান’ শাসনামলে সংবিধান থেকে এই শব্দটিকে ঝেটিয়ে বিদায় করা হয়েছিল। আজ বিজি প্রেস থেকে বাংলাদেশের যে সংবিধানটি ছাপা হয়, তাতে সংযোজিত আছে শব্দটি আর তা শুধুই শেখ হাসিনা আর তার নেতৃত্বে জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ দলীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদদের কল্যাণেই।

শেখ হাসিনা শুধু সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ফিরিয়েই আনেননি, তিনি নিজেও আজন্ম এই চেতনায় বিশ্বাস করেন এবং দেশটিকে একটি প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠার সব উদ্যোগই তার আছে। ডাক্তারির পাশাপাশি আমি প্রাণের তাগিদ থেকে আর যে দু’চারটি কাজে সময় দেই তার অন্যতম ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’। সংগঠনটির সদস্য সচিব হিসেবে দীর্ঘ দিনের জমে থাকা জঞ্জাল সরিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার তাগিদে আমাদের দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে নিত্য ছুটে চলা। আর আমি হলফ করে বলতে পারি যে, এই চলার পথে আমি প্রতিনিয়তই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অন্তরিকতার প্রমাণ দেখি।

বক্তব্য রাখতে গিয়ে এই ব্রিটিশ সাংসদ তার বিএনপি প্রীতি লুকিয়ে রাখতে পারেননি। হতাশা ব্যক্ত করেছেন এক সময় আওয়ামী লীগ আর বিএনপির মধ্যে ক্ষমতার পালা বদল হলেও ইদানীং তা আর হচ্ছে না। তবে তিনি বেশ আশাবাদী! শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, এক সময় উত্তর আয়ারল্যান্ড আর দক্ষিণ আফ্রিকার পরিস্থিতিকে অসমাধান যোগ্য বলে মনে করা হলেও আজ যেহেতু সেসবের সমাধান হয়েছে, বাংলাদেশেও একদিন বিএনপি নিশ্চয়ই ক্ষমতায় ফিরে আসবে। একদমই অপ্রাসঙ্গিকভাবে তিনি তার বক্তব্যে কাশ্মীরকেও টেনে এনেছেন। আশা ব্যক্ত করেছেন সেখানেও একদিন পাকিস্তানী ফর্মুলায় একটা সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে। ভদ্রমহিলার এই ‘কিসের মধ্যে কি, পান্তা ভাতে ঘি’ টাইপ বক্তব্য থেকেই পরিষ্কার তিনি কিসের তাগিদে, কোন ঘরানার হয়ে, কাদের পক্ষে এসব প্রলাপ বকছিলেন।

ভদ্রমহিলার বক্তব্য আমার কাছে অসহায় পাগলের প্রলাপ বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু আমার মাথায় ধরে যাওয়া আগুন নেভাতে বেশ কষ্ট হয়েছে যখন দেখলাম তিনি জাতির পিতাকেও কটাক্ষ করেছেন। কি ঔদ্ধত্য, তিনি নাকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের জাতির পিতা হিসেবে স্বীকার করেন না। প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, তাতে কার কি এসে যায়? তার মতো সামান্য একজন ব্রিটিশ সাংসদ তো বঙ্গবন্ধুর নখেরও সমতুল্য নন। একদিন তার দেশের প্রধানমন্ত্রীই বঙ্গবন্ধুকে বরণ করে নিতে সব প্রটোকল ভেঙ্গে লন্ডনের ক্লারিজেস হোটেলে ছুটে এসেছিলেন। ওই হোটেলে সেদিন বাঁধভাঙ্গা জোয়ার নেমেছিল সরকার আর বিরোধীদলীয় ব্রিটিশ সাংসদদের, যারা বঙ্গবন্ধুকে শুধু একনজর দেখতে চেয়েছিলেন। অথচ বঙ্গবন্ধুর দেশটিকে তারা তখনও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতিই দেননি। শুধু তাই নয়, সেদিন ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত বিমানে চড়েই নয়া দিল্লী হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেছিলেন পাকিস্তানের কারাগার থেকে সদ্য মুক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।

অনেক কষ্টে যখন মাথাটা ঠান্ডা করি, তখনও জিভের অগ্রভাগে ঘোরাঘুরি করছে কিছু অনুচ্চারিত শব্দ। বলতে ইচ্ছে করে ‘রাবিশ’ কিংবা ‘খবিশ’। হয়ত সিলেটে জন্ম নেয়া পিতার রক্ত আমার ধমনিতে বহমান বলেই সহসাই আমার প্রিয় হয়ে উঠে অনুচ্চারিত শব্দদুটি। কিন্তু বলা আর হয়ে ওঠে না। কারণ আমার জনক তো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি কখনও ‘ওদেরকে’ পর ভাবেননি। তিনি জানতেন এদেশের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ তার দলকে ভোট দেয় না। তাঁর জানা ছিল, এদের অনেকেই নিত্য তাঁর অনিস্টও কামনা করে। তারপরও তিনি বলতেন, ‘আমার মানুষ’ আর ‘আমার দেশ’। তাঁর প্রতিপক্ষ ছিল পাকিস্তান, কিন্তু কখনই কোন বাঙালী বা বাংলাদেশ নয়। তাই জিহ্বার অগ্রভাগে উঠে আসা ‘খবিশ’ আর ‘রাবিশকে’ অনেক কষ্টে গলধঃকরণ করি। মিস্টার বিড়ালের প্রজন্মের জন্য আমার শুধুই করুণা আর ঘৃণা আর সঙ্গে ছোট্ট একটা প্রার্থনা, ‘পরম করুনাময় আপনি তো সবই পারেন- এই বোধহীন মানুষগুলোকে না হয় একটু বোধই দান করুন’।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here