মালয়েশিয়ায় সর্বত্র চলছে অভিযান!

0
286

খবর৭১ঃমালয়েশিয়ায় অবৈধ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযানে শত শত অভিবাসীকে আটক করছে সে দেশের ইমিগ্রেশন পুলিশ। জানা গেছে,বহুদিন মালয়েশিয়াতে থাকার পরও যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই, এই ধরপাকড় অভিযান নিয়ে তাদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

মালয়েশিয়ার পুলিশ ও ইমিগ্রেশন বিভাগ যৌথভাবে এই অভিযান চালাচ্ছে। কোথাও তারা হানা দিয়েছে, এ খবর জানামাত্র কমিউনিটির লোকজন ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে সবাইকে সতর্ক করে নিমেষে বার্তা পাঠাচ্ছেন। কিন্তু তাতেও ধরপাকড় এড়ানো যাচ্ছে না।

গত ২ মাসে বাংলাদেশিসহ সাড়ে ৮ হাজার অবৈধ অভিবাসীকে গ্রেফতার করেছে দেশটির অভিবাসন বিভাগ।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শহরে ইমিগ্রেশন, পুলিশ, রেলা, সিটি কর্পোরেশনের যৌথ অভিযানের কারণে অবৈধ অভিবাসীরা মালয়েশিয়ার বিভিন্ন ছোট ছোট শহর ও গ্রাম অঞ্চলের লোকালয়ে কাজ করছে এমন সংবাদ আগেই চলে যায় সংশ্লিষ্টদের কাছে। আর এই সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে জঙ্গল পর্যন্ত অভিযান পরিচালনা করছে অভিবাসন বিভাগ।

অভিবাসন সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় ২ হাজার ১০০টি অভিযানে আটক করা হয় ৩২ হাজার ৮৯৫ জনকে। আটকদের মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষে গ্রেফতার করা হয় বাংলাদেশিসহ বিভিন্ন দেশের ৮ হাজার ৫৫২ জন অবৈধ অভিবাসীকে।

এ ছাড়া অবৈধ অভিবাসী রাখার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়েছে ১৪৫ জন মালিককে। তবে অভিযানে বাংলাদেশিসহ অন্যান্য দেশের কতজন করে গ্রেফতার করা হয়েছে তা অভিবাসন বিভাগ প্রকাশ করেনি। মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন বিভাগের প্রধান দাতুক ইন্দিরা খায়রুল দাজামী বিজ্ঞপ্তিতে এসব তথ্য জানিয়েছেন।

আটককৃতদের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, নেপাল, মায়ানমার ও ভিয়েতনামের নাগরিকরাও রয়েছেন।

মানবাধিকার কর্মী হারুন আল- রশিদ রোববার যুগান্তরকে জানিয়েছেন, ভয়ে ভয়ে দিন-কাটানো এই অবৈধ বাংলাদেশীরা অনেকেই অভিযোগ করছেন কথিত এজেন্টদের হাতে প্রতারিত হওয়াতেই তারা আজ অবধি সে দেশে বৈধ শ্রমিকের স্বীকৃতি পাননি।

২০১৬র ফেব্রুয়ারিতে মালয়েশিয়ার সরকার রিহায়ারিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে এই অবৈধ শ্রমিকদের বৈধ হওয়ার একটা সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু যে তিনটি ভেন্ডর কোম্পানিকে এর দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে বেশ কিছু নকল এজেন্ট বা দালাল বাংলাদেশীদের সঙ্গে বিরাট প্রতারণা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

তিনি বলেন, আমরা প্রচুর এমন ঘটনা পেয়েছি, যেখানে বাংলাদেশী শ্রমিকরা না-বুঝে ওই ভুয়া এজেন্টদের হাতে চার থেকে পাঁচ হাজার রিঙ্গিত তুলে দিয়েছেন, তাদের আঙ্গুলের ছাপও নেওয়া হয়েছে – কিন্তু এজেন্টরা ওই টাকাটা মেরে দেওয়ায় তাদের আর কখনওই বৈধ হয়ে ওঠা হয়নি।

হারুন আল-রশিদ আরও বলেন, যেসব ভুয়া কোম্পানি শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা করে তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়েছিল সেগুলোর বেশির ভাগেরই মালয়েশিয়ান ও মালয়েশিয়ান নাগরিকদের চত্রছায়ায় মালিকানাও ছিল বাংলাদেশীদের।

মালয়েশিয়াতে শিল্পাঞ্চল অধ্যুষিত এলাকা পেনাংয়ে কর্মরত জুয়েল নামে এক বাংলাদেশী যেমন জানাচ্ছেন, ২০১৭ সালে বাংলাদেশের এজেন্ট তার কাছ থেকে চার হাজার রিঙ্গিত (বাংলাদেশী ৮০ হাজার টাকা) নিয়ে বিনিময়ে শুধু একটি মাই ইজির কাগজ (ভেন্ডর সংস্থা) ধরিয়ে দেয় ।

তারপর দীর্ঘদিন ঘুরেও আমার ভিসা না হওয়ার কারণে আমাকে এখন দেশে ফিরে যেতে হচ্ছে। টাকা ফেরত চাইতে গেলে ওই এজেন্ট বিভিন্ন প্রকার হুমকি-ধামকি প্রদর্শন করছে, বলছিলেন জুয়েল।

পাহাং জেলার কুয়ান্তান এলাকাতেও বাংলাদেশী এজেন্টদের হাতে প্রতারিত হয়ে প্রায় দুই থেকে তিনশো বাংলাদেশী এর মধ্যেই দেশে ফেরত যেতে বাধ্য হয়েছেন। এখন মালয়েশিয়ার তেরোটি প্রদেশ জুড়ে অভিযান শুরু হওয়াতে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন এই অবৈধ শ্রমিকরাই।

মালয়েশিয়ার স্থানীয় ব্যবসায়ী শাহীন মিয়া বলছিলেন, যখনই একটা এলাকায় অভিযান চালানো হচ্ছে, প্রথমেই বৈধ ও অবৈধ – সব বিদেশি শ্রমিককে ধরে এনে খোলা জায়গায় সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রোদ হোক বৃষ্টি-তাদের ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে।

তারপর কাগজপত্র পরীক্ষা করে যারা বৈধ তাদের ছেড়ে দেওয়া হলেও বাকিদের লরিতে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ক্যাম্পে। কিন্তু কাগজপত্র ঠিক থাকুক বা না-থাকুক, হেনস্থা হতে হচ্ছে সবাইকেই!

মানবাধিকার কর্মী হারুন বলেন, ক্যাম্পে নেওয়ার পরও অবৈধ শ্রমিকদের দুর্দশার শেষ হচ্ছে তা মোটেই নয়। ১৪ দিনের মধ্যে আদালতে পেশ করা হলে তাদের যে সাজা হয়, প্রথমে সেই মেয়াদটা জেলে কাটাতে হয়।

তারপর যদি তারা দেশে ফেরার টাকা জোগাড় করতে পারেন, তাহলে নিজেকে বিমানের টিকিট কেটে ফেরার ব্যবস্থা করতে হয়।

এ দিকে সম্প্রতি দেশটির ইমিগ্রেশন বিভাগের স্পেশাল পাস ইস্যুতে করারোপের কারণে অবৈধরা না-পারছেন মালয়েশিয়া ছেড়ে যেতে, আবার অবৈধ শ্রমিক হিসেবে সে দেশে থেকে গেলেও হেনস্থা হতে হচ্ছে পুলিশ ও ইমিগ্রেশন বিভাগের হাতে। সব মিলিয়ে এক দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে পড়েছেন এই হাজার হাজার বাংলাদেশী।

অভিবাসী বিভাগের মহাপরিচালক খায়রুল বলেন, বিদেশি শ্রমিকরা আজ বৈধ, কাল অবৈধ। বিগত দিনে আউটসোর্সিং কোম্পানির মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক বিদেশি শ্রমিকরা ভিসা করে প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলকারখানায় কাজ করতো। যা দেশটির শ্রমবাজারকে কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত করা হয়। বিদেশি শ্রমিকদের বাসস্থান ও কিঞ্চিৎ মজুরিতে জিম্মি করে বছরের পর বছর কাজ করানো হয়েছে এমন অভিযোগও রয়েছে সংশ্লিষ্ট দফতরে।

বর্তমানে মালয়েশিয়ায় আউটসোর্সিং কোম্পানির অ্যাপ্রোভাল বন্ধ রয়েছে। কিন্তু এখনো হাজার হাজার বিদেশিরা বিভিন্ন কোম্পানির নামে ভিসা করে অন্য কোম্পানিতে কাজ করছে। আর অন্যত্র কাজ করলেই তারা অবৈধ বলে বিবেচিত হবে।

অন্যদিকে বৈধ হয়েও অবৈধ তালিকায় বাংলাদেশিদের সংখ্যা দিনে দিনে বেড়ে যাচ্ছে। মালয়েশিয়ার বাংলাদেশি ও মালয় এজেন্টদের প্রলোভনে অন্যত্র কাজ করার নিশ্চয়তায় বাংলাদেশি শ্রমিকরা তাদের কোম্পানিতে ভিসা করেছেন।

প্রতি বছর এজেন্টকে ১ থেকে ২ হাজার মালয় রিংগিত দিতে হবে। কিন্তু বর্তমানে চলমান সাঁড়াশি অভিযানে বৈধ অবস্থায় গ্রেফতার হলে ওই সব এজেন্টের আর খোঁজ মেলেনি। বৈধ হয়েও জেলের গ্লানি টানছে বাংলাদেশিরা।

মালয়েশিয়া প্রবাসী মকবুল হোসেন বলেন, একজন অভিবাসী ইচ্ছে করে অবৈধ হয় না। দালালচক্র ইচ্ছে করে তাকে অবৈধ করে। বৈধ করে দেয়ার নামে একজন শ্রমিকের কাছ থেকে পাসপোর্ট ও আট থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায়।

তখন এই শ্রমিকের আর কিছু করার থাকে না। উদাহরণস্বরূপ আমি নিজেই। ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের আগস্ট পর্যন্ত অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় ফেরারি হিসেবে কাজ করি। ১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মালয়েশিয়ান একটি কনস্ট্রাকশন কোম্পানিতে কাজ করেছি।

মকবুল বলেন, আমাদের বাংলাদেশি শ্রমিকরা যদি দালালের কাছে না গিয়ে দূতাবাসের পরামর্শে ভালো কোম্পানিতে বৈধতা নিতো তা হলে তাদের সমস্যা সৃষ্টি হতো না। অথচ শ্রমিকরা মালয়েশিয়া আসার আগে তাদের পরিবারের সদস্যদের বা আত্মীয়দের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করে।

মালয়েশিয়ায় অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন শাহ আলম হাওলাদার। তিনি বলেন, সরকার শ্রম মাইগ্রেশন খরচ সস্তায় সীমাবদ্ধতার মধ্যে আনতে, নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে, এবং অভিবাসন সমস্যা এবং পুনর্গঠন সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

সম্প্রতি কিডনাপের অভিযোগে অভিযুক্ত দুই বাংলাদেশীকে পুলিশের গুলিতে নিহতের ঘটনায় রেশ কাটতে না কাটতেই ইমিগ্রেশনের অভিযানে গ্রেফতার করা হলো ৯ বাংলাদেশিকে। উদ্ধার করা হলো ১,১৫০ টি পাসপোর্ট, জাল ভিসা।

অভিবাসন বিভাগের প্রধান জানান, দীর্ঘদিন এই গ্রুপটি মালয়েশিয়ায় জাল পাসপোর্ট ভিসার স্টিকার সহ বিভিন্ন অপরাধে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আর এতে করেই বাংলাদেশের শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণকারীরা প্রমাদ গুণছেন ভবিষ্যৎ নিয়ে। হুমকির মুখে পড়েছে নতুন করে শ্রমিক নিয়োগের ব্যবস্থা এমনই মত প্রকাশ করলেন বাংলাদেশী কমিউনিটির নেতারা।

ইমিগ্রেশনের তথ্য মতে পাসপোর্ট না থাকা, ভিসা না থাকা, ভিসা নিয়ে অন্যত্র কাজ করা, কর্মস্থল থেকে পালিয়ে যাওয়া সংক্রান্ত অপরাধে বাংলাদেশি গ্রেফতার হয়। এসব সাধারনত অন্যের প্ররোচনা, দালাল ও এজেন্টের গাফিলতির কারণে হয়ে থাকে।

অপরদিকে বৈধ করা, ভিসা ও পাসপোর্ট সম্পর্কে নানান চক্রের রয়েছে সোস্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক অপপ্রচার যা বাংলাদেশি প্রবাসীদের হেয় করা হচ্ছে বলে অনেকে মত দিয়েছেন। মাদক পাচার, মাদক ব্যবসা ও মাদক ব্যবহার অপরাধও সম্প্রতি উদঘাটিত হয়েছে যেগুলোতে বাংলাদেশিদের নাম এসেছে।

বাংলাদেশি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী বলেন, মালয়েশিয়া সরকার সব সময় স্বচ্ছতার মধ্য দিয়ে শ্রমিক নিয়োগ দিলেও বাংলাদেশ থেকে শ্রমিকরা প্রতারিত হয়ে আসার কারণেই দীর্ঘদিন বাংলাদেশের শ্রমবাজার বন্ধ রয়েছে। সেই প্রতারণার ঘটনা মুছতে না মুছতেই কিছু কিছু বাংলাদেশীদের ইমিগ্রেশন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অপরাধের কারণে বাংলাদেশের শ্রমবাজার হুমকির মুখে পড়তে পারে এমন ধারনা অনেকের।
খবর৭১/এসঃ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here