মানিক ফকির এক অনুপ্রেরণার নাম

0
1389

শিল্পী রাণী হালদার: “হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান! তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান” দারিদ্র্য কবিকেও মহান করেছে। দারিদ্রের ক্ষুধাতুর কষাঘাতে কবি নজরুলও কিন্তু হয়ে উঠেছিলেন বিদ্রোহী। ঠিক তেমনিভাবে দারিদ্রের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মানিক ফকিরও হয়ে উঠেছিলেন চরম বিদ্রোহী। আর তাইতো তিনি ১ পা হারিয়েও নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন পরিবারের দায়িত্ব। তিনি অন্যের উপর নির্ভর কিংবা ভিক্ষাবৃত্তি করে কাটিয়ে দিতে পারতেন বাঁকি জীবন। কিন্তু তিনি তা করেননি। তিনি পেছনের সব দুঃখ ব্যাথা ভূলে নতুন করে শুরু করেন জীবন চলার পথ।
হ্যাঁ, বলছিলাম বাঘা উপজেলার সাহাপুর গ্রামে বেড়ে ওঠা মানিক ফকিরের কথা। তাঁর জন্ম এক হত দরিদ্র পরিবারে। ৮ ভাই বোনের মধ্যে মানিক ছিলো চতুর্থ। সুস্থ্য স্বাভাবিক আর ১০টা শিশুর মতোই তিনি জন্মেছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মাত্র ১৬ বছর বয়সেই তাঁকে ১টি পা হারাতে হয়। ভ্যান চালক বাবার উপার্জনে সংসার ঠিকমত চলতনা। তাই তার বাবা ভ্যান চালানোর পাশাপাশি ভাত ও সবজি রাখার ঝুড়ি বানাতেন। আর সেই ঝুড়িগুলো বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করতেন মানিক ফকির। প্রতিদিনের ন্যায় তিনি ঝুড়ি বিক্রি করে ট্রেন যোগে ফিরছিলেন বাড়ির পথে। কিন্তু মাঝ পথে ঘটে বড় এক দূর্ঘটনা।
দিনটি ছিল শনিবার। রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা ট্রেনটি বেলা ২টার দিকে নন্দনগাছি ও কালাবি পাড়ার মাঝামাঝিতে এসে লাইনচ্যুত হয়। বিকট শব্দ শুনতে পেয়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। জ্ঞান ফিরে আসলে বুঝতে পারেন তিনি বেঁেচ আছেন এবং দেখেন বুক পর্যন্ত মাটির মধ্যে পুঁতে আছে। স্থানীয় লোকজন তাঁকে উদ্ধার করেন। কিন্তু দেখা যায় ততক্ষণে তাঁর ১টি পা কাটা পড়েছে। তারপর চিকিৎসার জন্য তাঁকে রাজশাহী মেডিকেলে ভর্তি করানো হয়। ট্রেনের টিকিট থাকায় রেল কর্তৃপক্ষই তাঁর চিকিৎসার খরচ চালান।
দীর্ঘ ৩মাস মেডিকেলে থাকার পর তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন। অভাবের সংসারে বাবার পাশাপাশি তিনিও হাল ধরার চেষ্ঠা করেন। তাই বাবার সথে শুরু করেন কৃষি ও ঝুড়ি বানানোর কাজ। তাতেও সংসার চলেনা তখন তিনি তার পরিবারের সকলকে নিয়ে ঢাকায় চলে যান এবং গার্মেন্টসে কাজ শুরু করেন। সেখানে সিঁড়ি বেয়ে উঠা নামার সমস্যার কারণে আবার গ্রামে চলে আসেন মানিক ফকির। আবারো শুরু করেন বাবার শেখানো ঝুড়ি বানানোর কাজ। এ কাজে সাহায্য করেন তাঁর স্ত্রী ফিরোজা বেগম। বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারের পুরো দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর উপর। শুধু ঝুড়ি বিক্রি করে তো আর সংসার চলেনা তাই বাবার রেখে যাওয়া ভ্যানটি তিনি কষ্ট করে এক পায়ে চালানো শুরু করেন। যাত্রী বহন করে যে টাকা পান তা দিয়ে বাঁশ কিনে ঝুঁড়ি তৈরি করেন তিনি।
তাঁর এক মেয়ে এক ছেলে। দুই সন্তানকে ইতিমধ্যে তিনি সুন্দরভাবে বিয়েও দিয়েছেন। তারা এখন মোটামুটি স্বাবলম্বী। সব দুঃখ কষ্টকে পেছনে ফেলে মানিক ফকির এখন হাসছেন বিজয়ের হাসি। তিনি বলেন “নিজের চেষ্ঠা থাকলে কোন বাঁধা অতিক্রম করা কঠিন নয়। আমি পা হারিয়েছি কিন্তু মনোবল হারাইনি। ইচ্ছা করলে ভিক্ষা করে উপার্জন করতে পারতাম। কিন্তু ভিক্ষা করা ভালো নয় তাই শত কষ্ট হলেও বাবার শেখানো কাজ গুলো করেই সংসার চালাচ্ছি।”
ইচ্ছা শক্তির উপর ভর করে তিনি এগিয়ে চলেছেন নিরন্তর। তাইতো তিনি পরের উপর নির্ভরশীল না হয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সংগ্রাম করে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। মানিক ফকির আমাদের সমাজের বেকার যুবকদের জন্য এক অনুপ্রেরণার নাম। বিপদে দিশেহারা না হয়ে ধৈর্য্য ধরে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শিক্ষা পাই তাঁর কাছ থেকে। মানিক ফকিরের মতো দৃঢ় মনোবল নিয়ে প্রতিটি মানুষ সামনে এগিয়ে যাক। আত্মনির্ভরশীল হয়ে নিজের পায়ে সবাই দাঁড়াতে শিখুক।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here