মানসম্মত রেণু ও খাদ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধিতে নড়াইলের চিংড়ি চাষ হুমকির মুখে

0
1189

উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি : নড়াইলে চিংড়ি খামারিদের এখন দুর্দিন চলছে। মানসম্মত রেণুর সংকট, খাদ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ায় চিংড়ির ন্যায্য দাম না পাওয়ায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন চাষীরা। ফলে গত চার বছরে এ অঞ্চলে চিংড়ি চাষ উল্লেখযোগ্য হারে কমে এসেছে। নড়াইলের চিংড়িচাষীরা জানিয়েছেন, বিশ্ববাজারে গলদা চিংড়ির মূল্য হ্রাস এবং অস্বাভাবিক হারে রেণু মারা যাওয়ায় জেলার প্রায় আড়াই হাজার চাষী মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। গত বছর অতি বৃষ্টির কারণে চিংড়ির স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়েছে বলেও মনে করছেন অনেকে। জেলা মত্স্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০০০ সালের আগে নড়াইলে চিংড়ি চাষ হতো না। পার্শ্ববর্তী খুলনা ও বাগেরহাটের দেখাদেখি নড়াইলের সীমান্তবর্তী মির্জাপুর এলাকার মত্স্যচাষীরা নিজ উদ্যোগে স্বল্প পরিসরে চিংড়ি চাষ শুরু করেন। লাভজনক হওয়ায় এর চাষ ক্রমেই বাড়তে থাকে। ২০১৩ সালে জেলায় চিংড়ি ঘেরের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ হাজার ৩৭৮টিতে। তবে এরপর থেকেই এ সংখ্যা কমতে থাকে, বর্তমানে তা আড়াই হাজারে ঠেকেছে। জেলায় এখন ২ হাজার ৫২৯ হেক্টর জমিতে ২ হাজার ৬২১টি ঘের রয়েছে। আর এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অন্তত ১২ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা। চিংড়িচাষীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বরিশাল ও ভোলা থেকে তাদেরকে রেণু আনতে হয়। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসা রেণুর ১০ থেকে ২০ শতাংশ মারা যায়। কিন্তু এ বছর প্রায় অর্ধেক রেণু মারা গেছে। বাজারে চিংড়ির দামও কম। বর্তমানে প্রতি কেজি মাঝারি গ্রেডের চিংড়ি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা এবং ছোট গ্রেডের চিংড়ি ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা গত বছর ছিল ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা ও ৬০০ টাকা থেকে ৭০০ টাকা। চাঁচুড়ি গ্রামের চিংড়িচাষী তৌরুত মোল্যা জানান, দুটি ঘেরে দেড় লাখ রেণু ছেড়েছিলেন। কিন্তু ৬০-৬৫ হাজার মাছ পেয়েছেন। মাছের বৃদ্ধিও কম হয়েছে। এর মধ্যে বেশি দামে খাদ্য কিনে কম দামে মাছ বিক্রি করতে হচ্ছে। তার প্রায় ৫ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে। ফুলদা গ্রামের রাজিব মোল্যা বলেন, ‘এবার ভালো রেণু আসেনি। বেশির ভাগই মারা গেছে। কিন্তু সেটা বুঝতে না পেরে যে পরিমাণ রেণু ছেড়েছি, সেই হিসাবেই খাবার দিয়েছি। ফলে লোকসান বেড়েছে।’ তার প্রায় ১ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। তবে রেণুর মান নিয়ে চাষীদের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন কৃষ্ণপুর গ্রামের রেণু ব্যবসায়ী মদন বিশ্বাস। তার দাবি, আসলে এ বছর অতি বৃষ্টির কারণে মাছের বৃদ্ধি ভালো হয়নি। এছাড়া প্রতি কেজি পিলেট (মাছের খাবার) দুই বছর আগে ২৫-৩০ টাকা দরে বিক্রি হতো। বর্তমানে তা ৪৫-৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এদিকে চাষীদের অভিযোগ, উপজেলা মত্স্য কর্মকর্তারা তাদের কোনো খোঁজখবর রাখেন না। অফিসে গেলে প্রায়ই তাদের পাওয়া যায় না। পেলেও ভালো পরামর্শ দেন না। মাছের ঘের পরিদর্শনে তো আসেনই না। এ বিষয়ে চাঁচুড়ি বাজারের মত্স্য খাদ্য ব্যবসায়ী রবি ও সুশীল কুন্ডু বলেন, সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবেই চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মত্স্য খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বছরে দুয়েকবার চাষীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় বলেও জানান তিনি। নড়াইলে চিংড়ির চাষের এ অবস্থার বিষয়ে জেলা মত্স্য ঘের মালিক সমিতির নেতা আকরাম শহীদ চুন্নু বলেন, প্রাকৃতিক উেসর রেণুর সহজলভ্যতা, খাদ্যের কম দাম, ভালো উৎপাদনÍ সব মিলিয়ে লাভজনক হওয়ায় ১৫-১৬ বছর আগে নড়াইল জেলায় ঘেরে মিঠা পানির গলদা চিংড়ি চাষ ব্যাপক প্রসার পায়। কিন্তু সরকার প্রাকৃতিক উেসর রেণু আহরণ নিষিদ্ধ করায় চাষীরা হ্যাচারি মালিকদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। তাছাড়া খরচ অনুপাতে দাম না পাওয়াসহ বিদ্যমান নানা প্রতিকূলতা তো আছেই। এ বাস্তবতায় নড়াইল জেলায় চিংড়ি চাষের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত চাষীরা। চিংড়িচাষীদের সহযোগিতা না করার অভিযোগ অস্বীকার করে কালিয়া উপজেলা মত্স্য কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা সব ধরনের পরামর্শ দিয়ে থাকি। আর বৃষ্টির কারণে মাছের বৃদ্ধি না হওয়ার কারণ নেই। তবে রেণু মারা যাওয়ার ব্যাপারটা আমার জানা নেই।’ জেলা মত্স্য কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে বিশ্ববাজারে চিংড়ির চাহিদা কম। এছাড়া কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চিংড়িতে অপদ্রব্য পুশ করে। তাদের কারণেও বিশ্ববাজারে আমাদের চিংড়ির চাহিদা অনেকটা কমেছে। #

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here