মাদারীপুর জেলার ১৪ সিনেমা হল অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে,২ শতাধিক লোক বেকার হবার পথে

0
877

 

এস. এম. রাসেল, মাদারীপুর প্রতিনিধি:
আকাশ সাংস্কৃতির প্রভাব ,আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির ও মানসম্মত সিনেমা তৈরী না হওয়াসহ নানা সমস্যার কারনে মাদারীপুরের জেলার বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহগুলো অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। ফলে সিনেমা শিল্পের সাথে জড়িত জেলার প্রায় ২শতাধিক ব্যক্তি বেকার হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট কর্মচারীরা সময়মত তাদের বেতন না পাওয়ায় মানবেতর জীবন যাপন করছে অনেক পরিবার।
সরেজমিনে পরিদর্শন ও সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, মাদারীপুর জেলার ৪টি উপজেলায় মোট ১৪ টি সিনেমা হল ছিলো। এর মধ্যে মাদারীপুর সদর উপজেলার ইউনাইটেট টকিজ (মিলন সিনেমা হল নামে পরিচিত), ইউনির্ভাসাল টকিজ (বাদামতলা সিনেমা হল নামে পরিচিত), চরমুগরীয়া মুক্তা সিনেমা হল, খাগদিতে মনি সিনেমা হল, রাজৈর উপজেলায় সোনালী, রুপালী, প্রতিভা ও মহুয়া সিনেমা হল, শিবচর উপজেলায় সুরভী, মিথুন, পলাশী, এবং উৎরাইলে মেলডী সিনেমা হল, কালকিনি উপজেলায় সুরভী ও সাজন সিনেমা হল। মোট ১৪টি সিনেমা হলের মধ্যে বর্তমানে জেলায় ৬টি সিনেমা হল চালু আছে, তাও বন্ধ হওয়ার পথে। এর মধ্যে মাদারীপুর সদর উপজেলার ইউনাইটেট টকিজ সিনেমা হল, (ইউনির্ভাসাল টকিজ বাদামতলা সিনেমা হল, থাকলেও দর্শকের সংকট নিয়ে চলছে নিভু নিভু অবস্থায়। অপরদিকে রাজৈর উপজেলায় প্রতিভা সিনেমা হল ও টেকেরহাটে সোনালী সিনেমা হল এবং শিবচর উপজেলায় সুরভী সিনেমা হল ও পলাশী সিনেমা হল শুধু নাম মাত্র চালু রয়েছে। কালকিনি উপজেলায় সুরভী ও মুক্তা সিনেমা হল নামে দুটি সিনেমা হল এক সময় থাকলেও দর্শকের সংকটে প্রায় ১০ বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। কালকিনি উপজেলায় এখন কোন সিনেমা হল নেই বললেই চলে।
গত কয়েকদিন তিন চারটি সিনেমা হল ঘুরে জানা যায়, পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেখার মত দেশীয় মানসম্মত ছবি তৈরী না হওয়া এবং বিদেশী ইংরেজী যৌন স্পর্শকাতর ছবি চালু রাখার আদলে দর্শকরা দেশীয় সিনেমা উপভোগে বর্জন করাসহ সিনেমা বিমুখী হচ্ছে। পাশাপাশি অনেকেই ভারতীয় হিন্দি-বাংলা সিনেমার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সিনেমা হলের ভিতরে দর্শকের দেখার নেই কোন ভালো পরিবেশ বলতে গেলে রুচি সম্মত ছবির অভাব, এছাড়া ঘরে ঘরে টেলিভিশনের পাশাপাশি ডিসের লাইন, ভারতের বাংলা-হিন্দি সিনেমা, ইন্টারনেট, এন্ড্রয়েট মোবাইল সেট ইত্যাদির কারনে এ ব্যবসায় ধস নেমেছে বলে অনেকেই ধারনা করেন। ইতিমধ্যে অনেক সিনেমা হল ভেঙ্গে তারা নতুন করে দোকান পাট ও মার্কেট নির্মানের কাজে ব্যস্ত রয়েছে। আবার অনেকেই এ ব্যবসা নিয়ে হতাশায় দিন কাটাচ্ছে। এক সময় এই সিনেমা হলগুলো ছিলো এ জেলার গ্রাম বাংলার মানুষের আনন্দ বিনোদনের একমাত্র উপায়। সেই সঙ্গে সিনেমা হল গুলোতে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানও ছিল। অধিকাংশ লোক সিনেমা হলের ম্যানেজার পদে কর্মরত ছিল, আবার কেহ টিকিট মাষ্টার, রিল মাষ্টার, প্রচার ম্যান, গেইট ম্যান ইত্যাদি পদে চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু এসব লোক বর্তমানে বেকার হয়ে পড়েছে, আবার অনেকেই বেকার থাকতেই মারা গেছেন।
বাংলা সিনেমা দেখার দর্শক মোঃ এলিম আহমেদ বলেন, এ দেশেরে সিনেমা সামাজের উন্নয়ন, পরিবর্তনের কোন ভূমিকা রাতে পারছে না। বেশিরভাগ সিনেমাতেই নগ্নতার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় দর্শক সংকট। বাংলাদেশের বেশির ভাগ ছবিতে কোন মানসম্মত কাাহিনী খুজে পাওয়া যায় না। এসবের কারনেই দেশী ছিনেমা ছেড়ে দিয়েছে অনেক দর্শকরা। ভিড় করেছেন ভারতীয় বাংলা সিরিয়াল গুলোতে।
(ইউনাইটেড টকিজ) মিলন সিনেমা হলের দীর্ঘ ৩০ বছরের পুরোনো কর্মচারী মোঃ খলিল সরদার বলেন, আগে সিনেমা হলে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ছবি দেখতে আসতো, এখন আর তা দেখা যায় না, কারন বর্তমানে পরিবার নিয়ে দেখার মত কোন সামাজিক সিনেমা নির্মান হচ্ছে না। এমনকি ডিসে ঘরে বসে ৮০ থেকে ৯০ টি চ্যানেলে বিভিন্ন চাহিদামত সিনেমা ও নাটক দেখতে পারছেন। এছাড়া বর্তমানে সকলেই ইন্ট্রারনেট ব্যাবহার করেন। যে কোন পছন্দমত গান নাটক ছিনেমা ইচ্ছে করলে খুব সহজেই দেখতে পারেন ইউটিউবের মাধ্যমে। এমনি ইচ্ছে করলে ডাউনলোড ও করে নিতে পারেন। তাই ভালো সিনেমা নির্মান ছাডা দর্শকদের চাহিদা মেটানো খুবেই কঠিন বলে মনে করেন তিনি।
বাদামতলা সিনেমা হলের অপারেটার জগোদিশ গাঙ্গুলী ১৯৭২ সাল থেকে সিনেমা হলে কাজ করছেন, তিনি বলেন,বাদামতলা সিনেমা হলের নাম ইউনির্ভসাল টকিজ অনেকেই বাদামতলা সিনেমা হল বলে জানেন। এই সিনেমা হলের মালিক ছিলেন সুনিল ঘোস তিনি মারা যাওয়ার পর পুরোনো ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্য তাহার ছেলেরাই দেখাশোনা করেন। এক সময় সিনেমা হলে আমরা দর্শকদের কোন সিট দিতে পারতাম না ভিড়ের কারনে। তারপরও দর্শকরা টিকিট নিয়ে হলের ভিতরে দাড়িয়ে দাঁডিয়ে ছবি দেখতেন। বর্তমানে ডিশের লাইন বের হয়ে কেবলের মাধ্যমে ঘরে ঘরে পৌছে দিয়েছেন ডিশ ব্যাবসায়ীরা। যার কারনে আমদের সিনেমা হলের ব্যাবসায় ধস নেমেছে। ৮ থেকে ৯ জন কর্মচারী লাগে এই সিনেমা হলটি পরিচালনা করতে। এতে কর্মচারির বেতন প্রতিমাসে মালিকের লস দিয়ে  চালাতে হচ্ছে পুরোনো ঐতিহ্য  টিকিয়ে রাখতে। বর্তমানে সিনেমা হলের দর্শক নেই বললেই চলে। এভাবে চললে সিনেমা হলটি বেশি দিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন তিনি।

নাম  প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক একজন সিনেমা দেখার ভক্ত  বলেন, সত্যি কথা বলতে গেলে সিনেমা হলে ছবি দেখার মত কোন পরিবেশ নেই। অধিকাংশ সিনেমা হলেই দেখা যায় নোংড়া আবর্জনা ও গন্ধে ভড়া। সিনেমা হলে ঢুকলে নাক বন্ধ করে ঢুকতে হয় আবার নাক বন্দ করে বের হতে হয় যা এক কথায় হলের ভিতরের পরিবেশ এত নোংরা যে কোন মানুষ ছবি দেখতে গেলে অসুস্থ হয়ে বাসায় ফিরতে হয়। দ্বিতীয়ত বর্তমানে ভালো কোন সামজিক ছবি নির্মান হচ্ছে না। বর্তমানে অনেক ছবিতেই অশ্লীলতার ছোয়াটা ও যৌন আবেদনময়ী দৃশ্য বেশি দেখা যায়। ফলে যুব সমাজের নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে।

সাংস্কৃতিক ব্য্যক্তিত্ব ও মাদারীপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমীর  সাধারন সম্পাদক বজলুর রহমান মন্টু খান বলে বলেন, গ্রাম-বাংলার এ ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনার আদলে মানসম্মত ছবি তৈরী করা, বাংলাদেশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা এই মুর্হুতেই  খুবেই প্রয়োজন। তা না হলে সিনেমা হলের ব্যবসা  বন্ধ হয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন।

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক মোঃ ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, সত্যি কথা বলতে আমাদের দেশের মান সম্মত ছবি তৈরী না হওয়াতে সিনেমা হলগুলো দর্শক সংকটে ভুগছে। তাছাড়া সিনেমা হলগুলোর স্বাভাবিক পরিবেশ আগের মতো আর নেই। কেননা আধুনিক তথ্য ও প্রযুক্তির মধ্যেও ভারতের হলগুলোতে মানসম্মত ছবি পরিবেশন করা হয় বলে এখনো সেখানকার সিনেমা হলগুলো দর্শক ভীড়ে জমজমাট রয়েছে। একমাত্র মানসম্মত ছবি নির্মানের মাধ্যমে দেশের বন্ধ হওয়া বা অচল হওয়া সিনেমা হল আবার তাদের হারানো গৌরব ফিরে পেতে পারে বলে মনে করি।

খবর ৭১/ইঃ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here