“মাথা ঘুরে দেখি, আমার বাম হাতটা ঝুলে আছে”

0
447

আসাদুল ইসলাম সবুজ, লালমনিরহাট প্রতিনিধি: গামছা বেঁধে রক্ত বন্ধ করেই এক হাতেই অস্ত্র চালিয়ে হানাদারদের গুলির জবাব দিয়েছি। এরপর কখন যে সহযোদ্ধারা হাসপাতালে নিয়েছে বলতেই পারি না। জ্ঞান ফিরে দেখি আমার বাম হাতটা নেই। এসব কথাগুলো বলেছেন লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার কমলাবাড়ি ইউনিয়নের চরিতাবাড়ি গ্রামের যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন (৭৬)।
জানা যায়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াল দিনগুলিতে টকবগে যুবক আমির হোসেন স্থানীয় কুমড়িরহাট উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেনীর ছাত্র। পাকসেনা ও তার দোসররা গ্রামের নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের উপর নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে। এমন দৃশ্য তাকে চরম ভাবে ব্যাথিত করলে কয়েকজন বন্ধু মিলে ছুটে যান ভারতের শিলেগুড়ি মুজিব ক্যাম্পে। সেখানে একমাস প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অস্ত্র ধরেন ৭নং সেক্টরের অধিনে দিনাজপুর অঞ্চলে। দেশ মাতৃকা হানাদার মুক্ত করতে সেখানে প্রানপন যুদ্ধ করেন আমির হোসেন। ৭১ সালের বিভিষিকাময় দিনের স্মৃতিচারন করতে গিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আমির হোসেন জানান, হিলি বন্দর এলাকায় পাকসেনাদের ক্যাম্পে একদিন সেখানে অভিযান চালান ভারতীয় মিত্রবাহিনী। চলে পাকসেনাদের সাথে তুমুল যুদ্ধ। সেদিন মিত্রবাহিনীর বুলেটের জবাবে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গিয়ে দুরে আত্নগোপন করে। তখন মিত্রবাহিনী পাকসেনাদের ওই ক্যাম্প দখলে নেয়। এরই মধ্যে পাকসেনারা পুনরায় সংগঠিত হয়ে চারদিক থেকে মিত্রবাহিনীকে আক্রমন করে। এদিনে মিত্রবাহিনীর অসংখ্য সৈনিক শহীদ হন। এ হামলার খবরে পুনরায় মিত্র ও মুক্তিবাহিনী সম্মিলিত ভাবে আক্রমন করে হিলি থেকে নিচিহ্ন করা হয় হানাদারদের, যোগ করেন আমির হোসেন। ডিসেম্বরশুরুতে দিনাজপুরের কয়লাডাঙ্গীর পাকসেনাদের ঘাঁটিতে রাতভর আক্রমন চালায় মুক্তিবাহিনী। সেদিন ৩জন শহীদ হন আর আহত হন ২৩জন সহযোদ্ধা। সারা রাত অস্ত্র চালিয়ে ক্লান্ত আমির হোসেন ভোরের দিকে তার ব্যবহৃত ৭.৬২ এলএনজি’র বেরেল হাত বদল করতে গিয়ে শক্রদের একটি গুলি লাগে তার বাম হাতের কনুইয়ের উপরে এতে তার বাম হাতটা ঝুলে আছে, অঝোরে রক্ত ঝড়ছে। গামছা পেঁচিয়ে শক্ত করে হাত বেঁধে শুধুমাত্র ডান হাতেই অস্ত্র চালিয়ে বেশ কিছুক্ষণ হানাদারদের গুলির জবাব দিয়েছি।” এরপর কিছুই বলতে পারি না। জ্ঞান ফিরে দেখি বাম হাতটা নেই। শুয়ে আছি ভারতের বালুর ঘাট হাসপাতালে। সেখানেই শুনতে পাই প্রিয় মাতৃভুমি স্বাধীন হয়েছে। পরে সেখান থেকে খিরকী হাসপাতালে ৯মাস চিকিৎসা নিয়ে সোজা চলে যাই ঢাকায় প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষাত করতে। সেদিন বঙ্গবন্ধু বক্শিস হিসেবে টাকা দিয়েছিলেন। তবে পরিমানটা জানা নেই, যোগ করেন আমির হোসেন।
আমির হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের ঘোষনা দিয়েই বসে থাকেন নি। নিয়মিত সৈন্যের খবর নিতেন। ভারতের হাসপাতালে চিঠি পাঠিয়ে বঙ্গবন্ধু আমাকে বাড়ির খবর জানিয়েছেন। চিন্তিত বৃদ্ধ বাবাকে হাসপাতালের খবরটাও চিঠির মাধ্যমে পাঠিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। সাথে ৫শত টাকার একটি চেক। সে চিঠিগুলো আজ শুধুই স্মৃতি। তবে দুঃখ হয়, যখন অভিভাবক তুল্য বঙ্গবন্ধুর ওইসব স্মৃতি মনে পরে। প্রিয় নেতাকে হারানোর বেদনায় ডুকড়ে কান্না করি এখনও, যোগ করেন আমির হোসেন। যুদ্ধে বাম হাতটা হারিয়ে সম্পুর্ন রুপে কর্মহীন হয়ে পড়েন আমির হোসেন। বাবার পৈত্রিক সম্পত্তির আয়েই চলত স্ত্রীসহ ৪ ছেলে মেয়ের সংসার। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার সম্মানি ভাতায় চলছে এক ছেলে ও এক মেয়ের লেখাপড়া।

খবর ৭১/ এস:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here