ব্লু ইকোনমি’ বাস্তবায়নে গতি মন্থর

0
341

খবর৭১; ব্লু ইকোনমি’ বাস্তবায়নে ধীরগতির কারণে প্রতিবেশী দেশ দুটির চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। মিয়ানমার ও ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা বিরোধ সমাধান হয়েছে যথাক্রমে ছয় ও চার বছর আগে। অথচ এই সময়ের মধ্যে সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ব্লক ইজারা দেয়া দূরের কথা; এখনো পর্যন্ত বণ্টনের শর্তও চূড়ান্ত করতে পারেনি বাংলাদেশ।

এছাড়া গত প্রায় দুই দশক ধরে সমুদ্রে মৎস্য জরিপ হয় না। যার কারণে সাগরে মাছের সঠিক অবস্থা সম্পর্কে প্রকৃত কোন তথ্য নেই খোদ সমুদ্র মৎস্য জরিপ অধিদপ্তরের কাছে। এছাড়া সাগরকেন্দ্রিক পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ও বিদেশী পর্যটক আকর্ষণেও নেই তেমন বড় কোন উদ্যোগ। এ ছাড়া সমুদ্রে মৎস্যসম্পদ আহরণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য দক্ষ জনবলও গড়ে ওঠেনি। সমুদ্র বাণিজ্যে অধিকাংশ জাহাজ বিদেশী মালিকানাধীন থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার বেশির ভাগই বিদেশে চলে যায়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানসহ ব্লু ইকোনমি বাস্তবায়নে ধীর গতির কারণে সুযোগ হারাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্ব বাজারে তেল গ্যাসের দরপতনের কারণে বিদেশী কোম্পানিগুলো সাথে লাভজনক কোন চুক্তি করাও সম্ভাবনা এখন নেই। অনেক ক্ষেত্রে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বিদেশী কোম্পানিগুলো।

এদিকে মিয়ানমারের জাতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, গভীর সমুদ্রের বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানা সংলগ্ন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের এডি-৭ ব্লকে দুটি গ্যাস ক্ষেত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে। এছাড়া বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানা সংলগ্ন রাখাইন রাজ্যের এডি-১১ ও এডি-৯ ব্লকে ত্রিমাত্রিক সার্ভে শুরু করেছে নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ‘শেল’। ২০১৩ সালে মিয়ানমার সমুদ্রে ১৩টি ব্লকের ইজারা সম্পন্ন করে। এখানে সব ব্লকেই ব্যাপক অনুসন্ধান চলছে। বেশ কিছু ব্লকে গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে বলেও তথ্য প্রকাশ করা হয়।

জানা গেছে, সমুদ্রের কোন কোন এলাকায় কী কী মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ রয়েছে সে বিষয়ে জরিপে এর জন্য কোনো জাহাজ নেই বাংলাদেশের। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতের ছয়টি রাজ্যের অধীনে ১১টি জরিপ জাহাজ সাগরে নিয়মিত অনুসন্ধান করছে বলে ফিশারি সার্ভে অব ইন্ডিয়া ২০১৪-১৫ প্রতিবেদনে জানা যায়। জরিপে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গবেষণা, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ আহরণ করা হয় সেখানে। এদিকে বাংলাদেশের বেশির ভাগ ফিশিং জাহাজে একটি ইঞ্জিন থাকায় বোটগুলো ৩৫ কিলোমিটারের বাইরে যেতে পারে না। অথচ সমুদ্রের ৬৬৪ কিলোমিটার পর্যন্ত বাংলাদেশের এলাকা। প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কার জাহাজ বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় তারা গভীর সমুদ্রের মাছ ধরতে পারে।

১৯৯৮ সালের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে সাগরে ৪৭৫ প্রজাতির মাছ আছে। এগুলো এখন কি অবস্থায় আছে তথ্য নেই সমুদ্র মৎস জরিপ অধিদপ্তরের কাছেও। এদিকে অধিদপ্তরটি আছে জনবল সংকটেও।

সমুদ্র মৎস্য জরিপ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, বেহুন্দি জালের ব্যবহারের কারণে সাগরে অনেক মাছ ও প্রাণিসম্পদের জীবন সংকটাপন্ন। বেশ কিছু মাছের উৎপাদন পূর্বের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে। প্রকৃত তথ্য না থাকায় কোন সীদ্ধান্তে যাওয়া যাচ্ছে না। সাগরে মাছ ধরে ফিরে আসা জেলে দের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ ছাড়া এই অধিদপ্তরের আর কোন কাজ নেই।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে শিক্ষক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, সাগরের সম্পদ ব্যবহারের দিক থেকে প্রতিবেশী দেশগুলো আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। আমরা এখনও সম্পদের অংশীদারিত্বের শর্ত ঠিক করতে পারিনি। মেরিটাইম ব্লক লিজের প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। ভারত ও মিয়ানমার বাংলাদেশ সংলগ্ন যে ব্লকগুলোতে তেল গ্যাস পেয়েছে বাংলাদেশও সেখানে তেল গ্যাস পাবে বলে নিশ্চিত করে বলা যায়। কারণ এই ব্লকগুলো বাংলাদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই কমনসেন্সে এটা বলা যায়। ব্লকগুলো যুক্ত হওয়ায় যারা আগে গ্যাস তেল উত্তোলন শুরু করলে তারাই বেশি লাভবান হবে।

পুরো প্রক্রিয়া শেষ করতে বাংলাদেশ অস্বাভাবিক বিলম্ব করছে জানিয়ে তিনি বলেন, ছয় বছর আগে মিয়ানমার ও চার বছর আগে ভারতের সাথে সমুদ্র বিরোধ মীমাংসা হয়েছে। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, গত সময়গুলোতে আমরা কি করলাম। গত দুই বছর ধরে বিদেশী কোম্পানি বাংলাদেশের সাগরে খনিজ সম্পদ আহরণে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। চীনের এখনও আগ্রহ আছে। তবে ভারত ও আমেরিকা চীনকে বঙ্গোবসাগরে আসতে দিবে না বা দিতে চায় না। আমেরিকা এই অঞ্চলে চীনা বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা।

এদিকে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেল ও গ্যাসের অব্যাহত দরপতনের কারণে বাংলাদেশে এই মুহূর্তে আকর্ষণীয় কোন প্রস্তাব পাবার সম্ভাবনা নেই। তিনি বলেন, সৌদি আরব, ইরান, রাশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির কারণে তেলের দাম এখন কিছু সময় হয়তো আর বাড়বে না। ১৫০ ডলারে ছোঁয়া জ্বালানি তেলের দাম এখন ৪০ ডলারের নিচে। বাংলাদেশ যদি আর্কষণীয় প্রস্তাব পেতে চায় তবে জ্বালানি তেলের দাম ৭০ ডলারের বেশী হতে হবে।

গত অর্থবছরে সমুদ্রপথে ছয় হাজার ৬০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। এ জন্য ৬০০ কোটি ডলার জাহাজ ভাড়া দিতে হয়েছে। অধিকাংশ জাহাজ বিদেশী মালিকানাধীন থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার বেশির ভাগই বিদেশে চলে যায়। সমুদ্র মৎস্য জরিপ অধিদপ্তরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ইকবাল হারুন বলেন, দীর্ঘদিন জাহাজের অভাবে মাঝ সাগরে মৎস্য জরিপ করা সম্ভব হয়নি। এজন্য মালয়েশিয়া থেকে একটি জাহাজ কেনা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ইতিমধ্যে গভীর সমুদ্র অঞ্চলে ১২, ১৬ ও ২১ নম্বর ব্লক থেকে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের জন্য ইওআই আহ্বান করা হয়েছে। মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা হচ্ছে, মডেল অ্যাগ্রিমেন্ট অনুসরণে অফশোরে নন এক্সক্লুসিভ সার্ভে/মাল্টি ক্লায়েন্ট সিসমিক সার্ভে কার্যক্রম দুই বছরে সমাপ্ত করা হবে।

উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ১৪ মার্চ ইটলসে প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ২০১৪ সালের ৭ জুলাই ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বিষয়টি সুরাহা হওয়ায় বাংলাদেশ শেষ এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে পেরেছে।
খবর৭১/জি:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here