বেড়েই চলছে শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নিপীড়ন

0
460

খবর৭১ঃ বেড়েই চলেছে যৌন হয়রানি। স্কুল-মাদ্রাসা এক্ষেত্রে নিরাপদ নয়। স্কুলের শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নিপীড়নের ঘটনা বেড়ে চলেছে। স্কুল বা মাদ্রাসার শিক্ষকদের বিরুদ্ধে এই যৌন নিপীড়নের অভিযোগ বেশি।

বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের দেয়া তথ্যমতে, জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই ছয় মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশুদের হত্যা এবং নির্যাতনের সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে। গত ছয় মাসে ৮৯৫ জন শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১০৪ জন শিশু হত্যার শিকার হয়েছে, ৪০ জন শিশু আত্মহত্যা করেছে, নিখোঁজের পর ১ জন শিশু এবং বিভিন্ন সময়ে ১৭ জন শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছে ৪১ জন শিশুর। তবে নারী ও শিশু নির্যাতনের ওপর সারাদেশে জরিপ পরিচালনাকারী বেসরকারি সংস্থাগুলো পৃথকভাবে স্কুল-মাদ্রাসায় শিশু শিক্ষার্থীদের যৌন নিপীড়নের ওপর তথ্য সংগ্রহ করে না।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের বিষয়টি শিক্ষার্থীরা জেনে বা না জেনে প্রকাশ করে না। দুই-একটি ঘটনার প্রতিবাদ করলে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে অভিযুক্ত শিক্ষক গ্রেফতার হচ্ছেন। এরকম একটি ঘটনা ঘটেছে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার মাহমুদপুরের বায়তুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসায়। কয়েকদিন আগে মাদ্রাসার এক শিশু শিক্ষার্থী তার মা মোবাইল ফোনে যৌন নিপীড়নের দায়ে এক শিক্ষক গ্রেফতারের সংবাদ দেখছিলেন। গ্রেফতারের কথা শুনে ঐ শিক্ষার্থী তার মাকে বলে যে তাদের মাদ্রাসার অধ্যক্ষও এ রকম নির্যাতন চালায়। তাকে কেন র্যাব গ্রেফতার করছে না। এ কথা শুনে শিক্ষার্থীর মা র্যাবের কাছে অভিযোগ করেন। র্যাব তদন্ত করে দেখে যে বায়তুল হুদা ক্যাডেট মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আল আমিন (৩৫) অন্তত ১২ জন শিশু শিক্ষার্থীর ওপর যৌন নিপীড়ন চালিয়েছে। এরপরই র্যাব ঐ অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে।

গত ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে ডেকে ভবনের ছাদে নিয়ে শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এর আগে নুসরাত তার মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদদৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মামলা করে। এই মামলায় পুলিশ সিরাজউদদৌলাকে গ্রেফতার করে। এর প্রতিশোধ হিসেবে অধ্যক্ষ তার বাহিনীকে দিয়ে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এর রেশ কাটতে না কাটতেই নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে মিজমিজি অক্সফোর্ড হাইস্কুলের শিক্ষক আরিফুল ইসলামের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। শুধু ঐ শিক্ষার্থী নয়, ধর্ষণের ভিডিও ফুটেজ ঐ শিক্ষক অন্য শিক্ষার্থীদেরও দেখিয়ে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করতেন। এই অভিযোগ পাওয়ার পর র্যাব-১১ এর একটি টিম গত ২৭ জুন সেই শিক্ষককে গ্রেফতার করে। আর এই গ্রেফতারের খবরটি এক শিক্ষার্থী তার মায়ের মাধ্যমে শোনার পর তার মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ ওঠে।

শিক্ষার্থীদের ওপর যৌন নিপীড়নের ঘটনা দেশের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুলেও ঘটেছে ২০১১ সালে। স্কুলের শিক্ষক পরিমল জয়ধর বাসায় প্রাইভেট পড়ানোর সময় এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ঐ ভিডিও ফুটেজ ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। এর পরই পরিমল জয়ধরকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করে।

ফেনীর মাদ্রাসার শিক্ষার্থীর গায়ে আগুন ধরিয়ে হত্যার ঘটনার পর গত ২০ এপ্রিল দেশের সব মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে জরুরি ভিত্তিতে পাঁচ সদস্যের একটি করে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। এ আদেশ মোতাবেক প্রতিটি অফিস ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে জরুরি ভিত্তিতে একটি করে কমিটি গঠন করে তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে তা প্রকাশ করতেও বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এই নির্দেশে খুব একটা সাড়া দেয়নি। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর যথাযথ মনিটরিং করছে না।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নুরজাহান খাতুন বলেন, দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে দায়ের করা মামলাগুলোর মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ মামলায় অপরাধীর সাজা হয়। আইনে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে বিচার সম্পন্ন হওয়ার কথা বলা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বিচার পেতে ভিকটিমকে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়। কোনো একটি অপরাধ করার ক্ষেত্রে যদি অপরাধী দেখে যে, যে অপরাধের শিকার হবে, তার থেকে প্রতিহত হওয়ার সুযোগ কম থাকে, তখন অপরাধী আরো উত্সাহিত হয়। এ ধরনের অপরাধে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্কুল ও মাদ্রাসার তৃতীয় শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ভিকটিম। তিনি আরো বলেন, স্বাভাবিকভাবে ভিকটিমদের মধ্যে এ ধরনের অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার বিষয়টি জানা নেই। সামাজিকভাবে যৌন আচরণগুলো আমরা গোপন বিষয় বলে মনে করি। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে শিশুকে সচেতন করে তুলি না। বিচারহীনতার কারণে অভিভাবকরা এসব ঘটনার প্রতিবাদও করেন না। সামাজিকভাবে এটা এক ধরনের সম্ভ্রমহানিকর ভেবে অভিভাবকরা সব গোপন করে যান। এই সুযোগে অপরাধীরা তাদের অপরাধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষকদের কাউন্সিলিং করা প্রয়োজন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here