খবর৭১: দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে ঢাকার একটি নিম্ন আদালত পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। এরপর থেকে পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয়েছে তাঁকে। ওই রায় ঘিরে উত্তপ্ত দেশের রাজনীতি। কয়েক দশক ধরেই এমন চিত্র রাজনীতির। এ নিয়ে বিবিসি অনলাইনে একটি নিবন্ধ তুলে ধরেছেন গণমাধ্যমটির দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি জাস্টিন রাওলাত।
বাংলাদেশের রাজনীতির অবস্থা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘মেকিয়াভেলির চেয়েও বেশি, সান জু’কেও বাদ দিন। যদি জানতে চান কীভাবে শত্রুকে হারাতে হয় এবং সত্যিকার অর্থে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে হয়, তাহলে আপনার বাংলাদেশের রাজনীতির দিকে তাকানো উচিত।’
কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের দুই প্রধান নেত্রীর দীর্ঘ যুদ্ধের সর্বশেষ ফলাফল হচ্ছে বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার রায়। জাস্টিন রাওলাতের ভাষায়, ‘বাংলাদেশে এই দুই নেত্রীকে যুদ্ধরত বেগম হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়।’ অথচ তাদের সংঘাতে কোনো কিছুই যেন ‘নারীসুলভ’ নয়।
রাওলাতের ভাষায়, ‘বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার প্রতিপক্ষ খালেদা জিয়ার মধ্যে এই শত্রুতা দেশকে কয়েকবার সহিংসতার দিকে নিয়ে গেছে। পেট্রোল বোমা, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা নিত্যকার বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
পরিস্থিতি কিন্তু সব সময়ই এমন ছিল না। আশির দশকে স্বৈরাচার এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তারা একসঙ্গেই রাজপথে লড়েছিলেন। দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বাংলাদেশের এই দুই নেত্রীই এসেছেন রাজনৈতিক পরিবার থেকে। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে দুই পরিবারেরই রয়েছে অসামান্য অবদান। কিন্তু ট্র্যাজেডিটা শুরু হয় দুজন রাজনীতিতে আসার পর।
রাওলাত লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট। কিন্তু ১৯৭৫ সালে তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
খালেদা জিয়ার স্বামী জিয়াউর রহমান, স্বাধীনতার আরেক নায়ক- সামরিক বাহিনীর একজন গুরুত্বপূর্ণ কমান্ডার। সত্তরের দশকের শেষের দিকে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) প্রতিষ্ঠা করেন ও ১৯৭৭ সালে প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৮১ সালে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
এরশাদের বিরুদ্ধে একসঙ্গে আন্দোলন করলেও নব্বইয়ের দশকে ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে বিভক্ত হয়ে যান তারা। রাওলাতের ভাষায়, বিরোধীদের একপেশে করে রেখে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আছেন শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ।
সর্বশেষ ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। যদিও নির্বাচন শুরুর আগেই হারজিত নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। বিবিসির এই দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি লিখেছেন, ‘এটা শুধু এজন্যই নয় যে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা ব্যালট বাক্স ছিনতাই করেছিল। বিএনপিও ভোট বয়কট করেছিল। ফলে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে যায়- তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত হয়।’
রাওলাত বলেন, ‘আমি বাংলাদেশের এক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষককে জিজ্ঞেস করেছিলাম- প্রধান বিরোধী দল নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার পর অন্যরা কি নির্বাচনে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিতে পারতো না? তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তারা পারতেন। কিন্তু তারা নিজেদের প্রত্যাহার করে নেন। অথবা তাদের প্রত্যাহার করানো হয়েছে।’
সর্বশেষ নির্বাচনে জেতার পর থেকে বিএনপি নেতাদের হেনস্তা করে যাচ্ছে সরকার। এর রাজনৈতিক অংশীদার জামায়াতে ইসলামীকেও নির্বাচন থেকে নিষিদ্ধ রাখা হয়েছে। খালেদা জিয়ার রায়ের পর তিনি সম্ভবত আগামী ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। ধারণা করা হচ্ছে, এতে পুনরায় ধারাবাহিক বিজয় পাবেন শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের আইন অনুসারে, কারো দুই বছরের বেশি সাজা হলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। তবে খালেদা জিয়া আপিল করবেন। এতে নির্বাচনে লড়ার সুযোগ পেয়েও যেতে পারেন। আদালত সাজা ঘোষণার আগের দিন দলীয় কর্মীদের উদ্দেশ্যে খালেদা বলেন, ‘বিরোধীদলহীন খালি মাঠে আর কেউ গোল দেয়ার সুযোগ পাবে না।’
বিএনপি সমর্থকরা মনে করেন, যা কিছু করা হচ্ছে, সবই খালেদা জিয়া ও তার দলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য। এর আগে গত সপ্তাহে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিও) বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিরোধীদের গ্রেপ্তার ও আটক বন্ধে শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানান। বিরোধী সমর্থকদের বিক্ষোভ করতে না দিয়ে সরকার মত প্রকাশের অধিকার হরণ করছে বলেও অভিযোগ করে তারা।
সবকিছু শেষে সত্য হচ্ছে, দুই নেত্রীর এই অন্তহীন যুদ্ধে ক্লান্ত বাংলাদেশের মানুষ। জাস্টিন রাওলাত লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের রাস্তার পাশের দোকানগুলোতে কথা বলে দেখবেন, সবার মুখে এই একই কথা ধ্বনিত হচ্ছে। মনে হয়, বাংলাদেশের মানুষ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।’
খবর৭১/এস: