বাঁশির সাথে ৬৭ বছরের সখ্যতা বাঁশিওয়ালা আবুল হোসেনের

0
691

খবর৭১ঃ রাজিব আহমেদ, শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি:বাঁশের বাঁশি কেউ বলে সর্বনাশী বিষের বাঁশি। কেউ বলে শ্যামের আশীর্বাদ। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের বংশীবাদক ও বিক্রেতা আবুল হোসেনের জীবনে এই বাঁশি সর্বনাশ নয় বরং আশীর্বাদ হয়েই আছে। প্রায় শতাব্দির সমান জীবন জুড়ে বাঁশিতে সুর তুলে চলেছেন আবুল চাচা। দশকের পর দশক ধরে বাশির সুরে বিমোহিত করে রাখছেন অসংখ্য ভক্ত আর শিষ্যদের। সেইসূত্র ধরে ১৯৯৩ সালে হয়েছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সদস্য।

শাহজাদপুর উপজেলার নরিনা ইউনিয়নের যুগ্নিদহ গ্রামের মৃত মাখন সরদারের ছেলে আবুল হোসেন (৮২)। আবুল ওস্তাদ নামেই বেশি পরিচিত তিনি। কেবল বাঁশের বাঁশির জন্যই বিনিয়োগ করেছেন ৮২ বছরের বিরাট ক্যানভাসের একটা জীবন। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল বংশীবাদক হবেন। সেই তাগিদে বাবার ১৫ শতক ফসলী জমি বিক্রি করে সিরাজগঞ্জ শহরে ওস্তাদের কাছে যান বাঁশি বাজানো শিখতে। ওস্তাদের কাছে গিয়ে ১৫ বছর বয়সেই হাতে তুলে নেন বাঁশি।

খুব তাড়াতাড়ি আপন প্রতিভা ও প্রচুর মনের জোড়ে আয়ত্ব করেন বাঁশি বাজানো। তারপর বাঁশি বাজানোকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। সেই উত্তাল যৌবনে বাশি বাজানোর কাজ পান সেসময়ের জনপ্রিয় যাত্রাদল বাসন্তী অপেরাতে। টানা ২১ বছর বাসন্তী অপেরায় কাজ করেছেন বাংলাদেশের খ্যাতিমান সব শিল্পিদের সাথে। তারপর বাসন্তী অপেরায় দুঃসময় নেমে এলে কাজ করেছেন ছন্নছারা ভাবে কিছুদিন বিভিন্ন ঘেটু দলে।

এরপর সময়ের বিবর্তনে যাত্রা শিল্পে ভাটা পড়লে শিল্পি আবুল ওস্তাদের জীবনেও নেমে আসে দুঃসময়। অন্য কোন পেশায় নিজেকে মানাতে না পেরে বাঁশের বাঁশিই আবারো আকড়ে ধরেন। শুরু করেন বাঁশি বানানো। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বাঁশ সংগ্রহ করে নিজ হাতে বাঁশি বানিয়ে বিক্রি করতে থাকেন সিরাজগঞ্জের বিভিন্ন হাট বাজার ও মেলাতে। এই বাশি বাজিয়ে ও বিক্রি করেই চালিয়েছেন এক ছেলে, চার মেয়ে ও স্ত্রীসহ ছয়জনের সংসার।

এই ৮২ বছর বয়সেও অবসর নেই আবুল চাচার। প্রায় সময় শাহজাদপুর শহরের বিভিন্ন হাট বাজারে কাঁধে বাঁশি ভর্তি চটের ব্যাগ নিয়ে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মত বাঁশি বাজিয়ে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ঘুরে ঘুরে ১০ টাকা থেকে ১শ’ টাকা পর্যন্ত বাশি বিক্রি করেন আবুল ওস্তাদ। বিভিন্ন স্কেলের বাঁশিসহ (পুরো সেট) তিনি ১২ শ’ থেকে ১৫ শত টাকা বিক্রি করে থাকেন।

দূর-দূরান্তের বংশীবাদকরা তাদের পছন্দ মত বাঁশি তৈরি করে নিতে তার বাড়ি পর্যন্ত আসে। পরিশ্রমের তুলনায় দামে সস্তায় বিক্রি করেন তিনি। বিভিন্ন হাট-বাজারে বাঁশি বাজানোর সময় তার পিছন পিছন ছুটতে থাকে মানুষ। শাহজাদপুর সহ বিভিন্ন জায়গায় সাপ্তাহিক হাটবারে বাঁশির সুর শুনলেই এলাকাবাসী বলতে থাকে হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা আসছে। সৌখিন বাঁশি প্রিয় মানুষরা প্রায় সময় তাকে নিয়ে গাছতলা বা ছায়া ঘেরা নির্জনস্থানে বসে শুনে তার মধুর বাঁশি। যদিও তার জন্য লাগেনা কোন টাকা পয়সা।

তার পরেও প্রতিদিন গড়ে ১/২শ’ টাকা বাশি বিক্রি করেন আবুল চাচা। যা দিয়ে বর্তমানে এক নাতী ও স্ত্রীসহ ৩ জনের সংসার চলছে মোটামুটি। বাঁশিই এখন তার আয় উপাজর্নসহ জীবনের একমাত্র অবলম্বন। এখন ৮২ বছর বয়স হওয়ায় বার্ধক্যের কারণে আর আগের মত দূর দূরান্ত থেকে বাঁশ সংগ্রহ করতে পারছেন না।ফলে উপার্জনও কম তার। কিন্তু প্রকৃত শিল্পির মতই তিনি হাত পাততে শেখেননি। এ কারণে এ পর্যন্ত বয়স্ক ভাতাও জোটেনি কোন। তবু তার মনে নেই কোন কষ্ট। মনের আনন্দে এখনও তিনি বাঁশিতে সুর তুলে চলছেন অবিরাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here