পানির অভাবে থমকে দাঁড়িয়েছে তিস্তা পাড়ের হাজারো জেলের উপার্জন

0
320

আসাদুল ইসলাম সবুজ, লালমনিরহাট প্রতিনিধিঃ  তিস্তার বুকে ছুটে চলা জেলে আর মাঝি মাল্লাদের নেই আর আগের মত কর্মব্যস্ততা। পানির অভাবেই থেমে গেছে তাদের সংসারের চালিকা শক্তি। পানির অভাবের মতই থমকে দাঁড়িয়েছে লালমনিরহাটের তিস্তা পাড়ের হাজারো পরিবারের উপার্জন। ভারতের এক তরফা পানি নিয়ন্ত্রন করায় বাংলাদেশ অংশে তিস্তা এখন মৃত প্রায়। ফলে তিস্তা অববাহিকায় জীববৈচিত্র্য হুমকীর মুখে পড়েছে।
জানা গেছে, ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর বাংলাদেশে প্রবেশ করে ঐতিহাসিক এ তিস্তা নদী যা লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও গাইবান্ধা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারী বন্দর হয়ে ব্রক্ষপুত্র নদে মিশে যায়। তিস্তা নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় ৩১৫ কিলোমিটার হলেও বাংলাদেশ অংশে রয়েছে প্রায় ১২৫ কিলোমিটার।
ফলে শীতেই বাংলাদেশ অংশে তিস্তা মরুভুমিতে পরিনত হয়েছে। লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম ও নীলফামারী জেলার ১২৫ কিলোমিটার তিস্তার অববাহিকায় জীবনযাত্রা, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। দেশের অন্যতম সেচ প্রকল্প লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার তিস্তা ব্যারাজ অকার্যকর হওয়ার উপক্রম হয়েছে। তিস্তা নদীতে দিনভর মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা জেলেরা আজ কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। পায়ে হেঁটে তিস্তা পাড়ি দিতে পেরে খেয়া ঘাটের মাঝিরাও হয়েছেন বেকার ও কর্মহীন। কেউ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় গেলেও কেউ আবার তিস্তা ব্যারাজের সামনে সামান্য পানিতে পর্যটকদের নৌভ্রমনের আনন্দ দিয়ে আয় করছেন ডাল ভাতের অর্থ। সব মিলে চিরচেনা  তিস্তা আজ পানির ন্যায্য হিস্যা বঞ্চিত হয়ে ঢেউহীন মরুভুমিতে পরিনত হয়েছে। পানির অভাবে শুকিয়ে মরে যাচ্ছে গাছপালা। তিস্তা ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।
নানান প্রজাতির মাছের সমাহার এ তিস্তায় সব থেকে জনপ্রিয় বৈরালী/বুরাল মাছ। যা দেশের অন্যান্য এলাকায় অপ্রতুল। তিস্তার পানির অভাবে যা আজ বিলুপ্তির  পথে।  তিস্তা নদীর উপর নির্মিত তিস্তা রেল সেতু, তিস্তা সড়ক সেতু ও গংগাচওড়া শেখ হাসিনা সেতু যেন প্রহসনমূলকভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে ধু-ধু বালু চরের তিস্তার উপর। ব্রীজ থাকলেও পায়ে হেঁটেই পাড় হচ্ছে অনেকেই। ঢেউহীন তিস্তায় রয়েছে শুধু বালু কনা। তিস্তার বুকে জেগে উঠা চরের বালু কনায় ভুট্টা, আলুসহ বিভিন্ন সবজি চাষাবাদ হলেও সেচের অভাবে তা মরে যাচ্ছে। অধিক পরিশ্রম করে প্রতিদিন সেচ দিয়ে কৃষক চাষাবাদ করছেন। তবে আশানুরুপ ফলন না পাওয়ায় প্রতিবছর ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন চাষিরা।
তিস্তা পাড়ের জেলে সাইদুল ইসলাম জানান, তিন ছেলে মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তার সংসার চলে তিস্তায় মাছ ধরে। ভরা তিস্তায় দিনভর মাছ ধরে ৪/৫ শত টাকা আয় হলেও এখন মাছ কম তাই আয়ও কম। পানি না থাকায় তিস্তায় মাছও নেই। বর্ষাকালে বৈরালী, আইর ও বোয়াল মাছ পাওয়া গেলেও এখন আর নেই। তিস্তা ব্যারাজের সামনে সামান্য পানিতে দিনভর মাছ ধরে আয় হয় মাত্র দেড় থেকে দুইশত টাকা। যা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তাদের।
নৌকার মাঝি দেলোয়ার হোসেন জানান, বর্ষাকালে খেয়া পাড়ে ও জেলেদের নৌকা ভাড়া দিয়ে দৈনিক ৫/৬ শত টাকা আয় হত। কিন্তু এখন পানি শুন্য তিস্তায় নৌকা চলে না। তাই তিস্তা ব্যারাজে বেড়াতে আসা পর্যটকদের নৌভ্রমনের আনন্দ দিয়ে দিনভর ২/৩ শত টাকা আয় করে কোন রকম সংসার চালাচ্ছেন তিনি।
তিস্তা পাড়ের কৃষক তাহাজুল ইসলাম, আবুল মিয়া ও খালেক বলেন, বর্ষাকালে প্রচুর পানি ছেড়ে দেয়ায় সৃষ্ট বন্যায় ফসলহানীসহ ঘরবাড়ি হারা হয় এ অঞ্চলের মানুষ। আবার শুস্ক মৌসুমে ফসল রক্ষায় পানির প্রয়োজন হলেও তিস্তায় পানি দেয় না ভারত। ফলে শুস্ক মৌসুমেও পানির অভাবে ফসল নষ্ট হচ্ছে তিস্তা পাড়ে। নদী শাসন ও তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা না থাকায় তিস্তা নদী কৃষকের জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে।
তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টের দায়িত্বে থাকা লালমনিরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, আপাতত প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার কিউসেক পানি রয়েছে। যা সিলড্রাপ ও ক্যানালগুলো ভরে রাখা হয়েছে। এর চেয়েও পানি কমে গেলে সেচ প্রকল্প সচল রাখাই কষ্টকর হবে বলেও জানান তিনি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here