পরিকল্পিতভাবে রমজানের আগেই বাড়ানো হচ্ছে পণ্যমূল্য

0
236

খবর৭১ঃঅসাধু ব্যবসায়ী-সিন্ডিকেট এখন আর রমজানের অপেক্ষায় থাকছে না। রমজান শুরুর দুই মাস আগেই পরিকল্পিতভাবে রমজাননির্ভর পণ্যসহ সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে, যাতে রমজানে পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে- এমন অভিযোগ না করা যায়। বাজারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের বিশেষ তদারকি টিম কাজ করলেও এর সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা। উল্টো বেড়েই চলেছে নিত্যপণ্যের মূল্য।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সাম্প্রতিক এক বক্তব্যেও উঠে এসেছে সিন্ডিকেটের কারসাজির কথা। তিনি বলেন, চালের দাম বাড়ছে চার-পাঁচ জন বড় ব্যবসায়ীর কারসাজিতে। শুধু চালের বাজার নয়, পুরো ভোগ্যপণ্যের বাজারেই একাধিক সিন্ডিকেট সক্রিয়। এবার সিন্ডিকেটের সুযোগ নেই। বাজারে সবার মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হবে। তিনি আরও বলেন, গুটিকয়েক মানুষের লাভের জন্য দেশ স্বাধীন হয়নি। আর পবিত্র রমজান মাসের আগে পণ্যের অবৈধ মজুদ ও দাম বৃদ্ধির সুযোগ দেয়া হবে না।

কিন্তু ভোক্তাদের দাবি, বরাবরের মতো এবারও ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে পরিকল্পিতভাবে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে গত বছরের মতো এবারও বাড়ার চিত্র চলবে ৫-১০ রোজা পর্যন্ত। পরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সরকারের বৈঠকের পর তা আবার কমতে শুরু করবে। কিন্তু যে পরিমাণে দাম বাড়ে সে পরিমাণে আর কমানো হয় না। মাঝখানে মন্ত্রীরা সরকারের সাফল্য দেখিয়ে বলেন, নিত্যপণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। যদিও ততদিনে ক্রেতাদের পকেট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। এসব অসাধু ব্যবসায়ীর কাউকে কখনও শাস্তির আওতায় আনা হয় না।

সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সব ধরনের সবজির দাম এখন আকাশছোঁয়া। কিছু সবজির কেজি ছুঁয়েছে ১০০ টাকা। বাকিগুলোর বেশির ভাগের কেজি ৭০-৮০ টাকা। গত দুই মাসে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে ব্রয়লার মুরগির। দুই মাস আগে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল ১২০ টাকা, তা শনিবার বিক্রি হচ্ছে ১৬৫-১৭৫ টাকায়।

লাল লেয়ার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২২০-২৩০ টাকা কেজি, যা গত সপ্তাহেও ছিল ২১০-২২০ টাকা। পাকিস্তানি কক মুরগির কেজি ২৯০-৩০০ টাকা, যা গত সপ্তাহে ছিল ২৬০-২৮০ টাকা। এছাড়া এক মাস আগেও গরুর মাংসের কেজি ছিল ৪৮০-৫০০ টাকা। শনিবার রাজধানীর বাজারগুলোতে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ টাকায়। আর খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭২০-৮০০ টাকায়।

সব ধরনের মাছ বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে। দেড় মাস আগে পাঙ্গাশের কেজি ছিল ১২০ টাকা, কিন্তু এখন বিক্রি হচ্ছে ১৬০-১৭০ টাকা কেজিতে। টেংরা মাছ বিক্রি হচ্ছে ৭০০-৭৫০ টাকা কেজি, যা দুই মাস আগে ছিল ৪৫০-৫৫০ টাকা। তেলাপিয়া বিক্রি হচ্ছে ১৪০-১৬০ টাকা কেজি, যা দুই মাস আগে ছিল ১২০-১৪০ টাকা। রুই আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৩৫০-৬০০ টাকা কেজি, যা দুই মাস আগে ছিল ৩০০-৫০০ টাকা।

খোলা ও বোতলজাত সয়াবিন তেল এক মাসে লিটারে বেড়েছে ৫ টাকা। মসুর ডালের (নেপালি) কেজি গত মাসে ছিল ৯০-৯৫ টাকা, যা বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১০০-১১০ টাকায়। দেশি মসুর ডাল মানভেদে বিক্রি হয়েছে ৮৫-৯০ কেজি, যা দুই মাস ছিল ৮০-৮৫ টাকা। দেশি পেঁয়াজের দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৫-৩০ টাকা কেজিদরে। চিনি বিক্রি হচ্ছে ৫২-৫৪ টাকা কেজি, যা দুই মাস আগে ছিল ৫০ টাকা।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা মো. আকবর বলেন, রমজানে নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে না- সরকারের এমন ঘোষণার দুই-তিন মাস আগেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়াতে থাকেন ব্যবসায়ীরা। ফলে রমজানে আর পণ্যের দাম বাড়ে না। এবারও গত দুই মাস ধরে একটি একটি করে পণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে। মনে হচ্ছে রমজান ঘিরে পরিকল্পিতভাবে ব্যবসায়ীরা এটা করছেন। কারণ হুট করে বাড়ালে সবার চোখে পড়ে।

শান্তিনগর কাঁচাবাজারে কথা হয় ফরিদা আকতারের সঙ্গে। তিনি বলেন, সবকিছুর দামই অনেক বেশি। ব্রয়লার মুরগির দাম প্রতি সপ্তাহে বাড়ানো হচ্ছে। সবজি, মাছসহ অন্যান্য পণ্যের দামও বাড়তি। সবই পরিকল্পিতভাবে করা হচ্ছে।

রমজান আসার আগেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, বরাবরই দেখা যায়, ব্যবসায়ীরা রমজানে পণ্যের দাম খুব কম বাড়ায়। রমজান আসার এক-দুই মাস আগেই দাম বাড়িয়ে দেয়। তিনি বলেন, বর্তমান বাজারে সবকিছুই যেন বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে। তাই রমজান আসার আগেই এ বিষয়টি নিয়ে কঠোর মনিটরিং করে সংশ্লিষ্টদের ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া বাজার ব্যবস্থায় বর্তমানে কোনো ধরনের প্রতিযোগিতা নেই। তারা অযৌক্তিক মুনাফার উদ্দেশ্যে সময় ও সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়িয়ে আসছে। এ প্রবণতা ভোক্তা কিংবা সরকার কারও জন্যই শুভ নয়।

ব্যবসায়ী-সিন্ডিকেটের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আজ থেকে যদি বাজার ঠিকমতো মনিটরিং করা না হয়, তাহলে যে সিন্ডিকেট তৈরি হচ্ছে তা রমজান পর্যন্ত থামানো যাবে না। তাই এখন থেকেই সরকারের উচিত বাজার গভীরভাবে পর্যালোচনা করে তদারকি করা।

ভোক্তাদের উদ্দেশে গোলাম রহমান বলেন, রমজান ঘিরে ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে। ১৫ দিনের পণ্য যাতে একদিনে না কিনে- সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এতে বাজারে পণ্যের ঘাটতি দেখা দেয়। যার কারণেও ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের উপপরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, রমজানকে ঘিরে অধিদফতরের পক্ষ থেকে নিয়মিত বাজার তদারকি করছি। দিনে ৩টি টিম কাজ করছে। কিন্তু কাঁচাবাজারে পণ্যের দাম গায়ে লেখা না থাকায় কিছুই করা যাচ্ছে না। তাই আমরা এবার পাইকারি থেকে শুরু করে খুচরাতে তদারকি করব। বিশেষ করে পাইকারি বাজারে পণ্যের বস্তায় মূল্য লিখতে বলব। যাতে খুচরাতে এসে বেশি দামে বিক্রি করলে সহজেই ধরা যায়। অনিয়মের প্রমাণ মিললেই কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। তিনি আরও বলেন, সিটি কর্পোরেশন থেকে কোনো তালিকা দেয়া হলে বাজার মনিটরিংয়ে সুবিধা হয়। এখন বাজারে পণ্যের যে মূল্য আছে তা আর বাড়তে দেয়া হবে না। মোকাম, পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে তদারকি জোরদার করা হবে।
খবর৭১/ইঃ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here