উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি: নড়াইলে বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী,পৃথিবীতে কিছু বিচিত্র মানুষ সময়ের বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে জন্মগ্রহণ করেন। মহামানব হিসাবে যারা পরবর্তীতে স্বীকৃতি পায়। তাদের কিছু কিছু আচরণ বেশ চমকপ্রদ এবং আশ্চর্য ধরনের। পৃথিবীর ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রায় প্রত্যেক মহামানবেরই কিছু বিচিত্র খেয়াল বা শখ ছিল। জন্মভূমি যশোরের মাত্র বিশ কি.মি. দূরে নড়াইলে জন্মগ্রহণকারী বিশ্ববরেণ্য চিত্র শিল্পী এস এম সুলতানেরও কিছু বিচিত্র শখ ছিল। পশু-পাখির প্রতি তার প্রেম ছিল নির্মহ, অনিন্দ্য সুন্দর। হরেক রকম পশু-পাখি তিনি লালন করতেন। এর ভেতরই ছিল তার প্রগাঢ় সুখ। আমাদের নড়াইল প্রতিনিধি উজ্জ্বল রায় জানান, নড়াইলের সুলতান ম চত্বরে চারদিনব্যাপী ‘সুলতান উৎসব’ গতকাল (শনিবার) রাতে শেষ হয়েছে। উৎসবে চিত্রপ্রদর্শনী, শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাসহ আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এস এম সুলতান শিশু চারু ও কারুকলা ফাউন্ডেশন এবং বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের আয়োজনে সুলতান উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসএম সুলতান ১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট নড়াইলের মাছিমদিয়ায় বাবা মেছের আলী ও মা মাজু বিবির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। অসুস্থ অবস্থায় ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পর নড়াইলে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। এস এম সুলতানের ভেতর এক আশ্চর্য আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ছিল। মানুষ থেকে শুরু করে পশু-পাখি সকলেই সম্মোহিত হতো তার প্রতি। স্বাভাবিকভাবে বিড়াল দেখলে ইঁদুর ভয়ে পালায়, আবার কুকুর দেখলে বিড়াল ভয়ে পালায়। কিন্তু মজার ব্যাপার এস এম সুলতানের কাছে কুকুর, বিড়াল, ইঁদুর এক সাথেই বসবাস করত; কিন্তু একে অপরকে আহত বা জখম করত না। এখানেই অপার রহস্য ঘণীভূত হয়ে আসে। যে মানুষ নিজের কথা কখনো ভাবেনি, শুধুই ভেবেছে অন্যের উপকারের কথা, সে মানুষটিই অসীম এক জগতের রহস্যময় সত্তা। একবার এক বানর উঁচু গাছে উঠে তাল সামলাতে না পেরে মগডাল থেকে পড়ে যায়। এতে বানরটির এক পা ভেঙে যায়। সুলতান নিজে সেই বানরটি নিজ বাড়িতে এনে পায়ে ব্যান্ডেজ করে চিকিৎসা করতে থাকেন। এক সময় বানরটি সুস্থ হয়ে যায়। তবে সে সুলতানকে ছেড়ে অন্য কোথাও কখনো চলে যায়নি। সুলতানের ছিল প্রচ- এক অজগর সাপ। ফোঁষ ফোঁষ করত সারাক্ষণ তার পাশে। কুকুর আর অজগর একই সাথে কাটাত সময়। অজগর কুকুরকে পেঁচিয়ে তার গায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলত আবার কুকুরটি অনেক সময় সাপের গা চেটে দিত। বিচিত্র মায়ার বন্ধনে সকল অবলা পশু-পাখিই যেন ধরা পড়েছিল। সবাই কেমন নির্মহ এবং ত্যাগী হয়েছিল। ময়না ও টিয়া এক সাথে থাকতেই চায় না। শুধু ঝগড়া-বিবাদ করে। অথচ তার কাছে ময়না, টিয়া, কবুতর, মোরগ, ময়ূর সব এক সাথেই বসবাস করত। কখনো ময়না, টিয়া সুলতানের ক্যানভাসের ওপর মলত্যাগ করে একে অপরের গা চুলকাতো। পেখম ঝাড়ত। সেসব দৃশ্য খুবই মজার! বাড়িতে ছিল বড় বড় গাভী। তাদেরও সে খুবই ভালোবাসত এবং তার অনেক ছবিতে পরিপুষ্ট গাভীর ছবি পাওয়া যায়। ছোট ছোট খরগোশ তার আঙ্গিনাকে ধবল-শুভ্র করে রাখত। ভল্লুক, হনুমানও ছিল সুলতানের সঙ্গী। অনেকগুলো বেজীও দেখা যেত তার বাড়িতে। সব কিছু মিলিয়ে বহু ধরনের জীব-জন্তু সে পুষত। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে সামনে রেখে এগিয়ে চলতেন তিনি। কখনো নিজের স্বকীয় সত্তাকে বিলীন করে দেননি। শাড়ি, চুড়ি এসব পরে ঘুরে বেড়াতেন। মাথায় লম্বা চুল। হাতে বাঁশের বাঁশরী। চমৎকার অদ্ভুত চলন বলন ছিল তার। ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত অমায়িক ধরনের মানুষ। সুলতানের ছিল বিচিত্র শখ। অমাবস্যা ও পূর্ণিমার রাতে তিনি রাধা সেজে নৃত্য করতেন। জানা যায়, গভীর রাতে তার কাছে বহু ধরনের সাপ আসত। পশু-পাখির প্রতি তার প্রেম ছিল অনবদ্য। তিনি পশু-পাখির মনের ভাষা বুঝতে পারতেন। আর সে জন্যই পশু-পাখিরা তাকে ত্যাগ করে চলে যেত না। চমৎকার ঘনিষ্ঠতা ছিল তার সাথে। এস এম সুলতান জীবনে বহু অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং একক চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে বিভিন্ন স্থানে। পৃথিবীর বিখ্যাত চিত্র শিল্পী পাবলো পিকাসো, সালভেদর দালি, পল ক্লী, ব্রাক প্রমুখের সাথে যৌথ চিত্র প্রদর্শনী হয়েছে। এস এম সুলতান পৃথিবী খ্যাত হয়েছেন এবং তিনি ছিলেন এশিয়ার প্রথম চিত্র শিল্পী যিনি চিত্রের বোধ পাল্টে দেন সমগ্র পৃথিবীতে। খুব সাধারণ মানুষ, কৃষক, তাঁতি, গৃহিণী তথা সহজ বাস্তবতাকে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তুলির প্রতিটি আঁচড়ে। রাজমিস্ত্রির ঘরে জন্মগ্রহণ করেও তিনি বিশ্বখ্যাত হয়েছেন। এ্যাবস্ট্রাক্টের বদলে রিয়ালিস্টিক রূপই তিনি বেশি ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতা ক্যানভাসে তুলির আঁচড়ে বাস্তব করে তুলেছেন। পশু-পাখির প্রতি যে ভালোবাসা তিনি দেখিয়েছেন তা এক ব্যতিক্রমী ব্যাপার। এক অভূতপূর্ব আশ্চর্য নিমগ্ন মানুষই শুধু এ রকম করতে পারেন। মানুষ হয়েও এস এম সুলতান পশু-পাখির খুব কাছাকাছি আপন হয়ে থাকতেন, তিনি এক মহান আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী, এক অফুরন্ত সত্য, এক অনিন্দ্য বিস্ময়।
খবর৭১/ইঃ