নড়াইলে বিলুপ্ত হয়ে গেছে হীরালাল সেনের জাদুর বাক্স বায়স্কোপ

0
841

উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি: নড়াইলে দিনবদলে কত কিছুই না গেছে, আর কিছু যাচ্ছে। নিজস্ব অনুপ্রেরণায় হীরালাল সেন ১৮৯৮ সালে এ দেশের বিভিন্ন স্থানে বাণিজ্যিকভাবে বায়স্কোপ  দেখানো শুরু করেন। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে দেশজুড়ে। প্রথম প্রথম বড় আকারের ফটোগ্রাফ বা হাতে আঁকা ছবি ব্যবহার হতো। আর চলত জারিগানের সুরে সুরে ধারা বিবরণী, সঙ্গে করতালের তাল। আগে থাকত ক্ষুদিরামের ফাঁসি, বেদের মেয়ে জোসনা, আগ্রার তাজমহল, মক্কা-মদিনার ছবি, কারবালা প্রান্তরের যুদ্ধ, তীরবিদ্ধ রক্তাক্ত দুলুদুল ঘোড়া, কাজী নজরুল ইসলাম ইত্যাদি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে ছবির বিষয়ে। এরপর যোগ হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান, ইন্দিরা গান্ধী, জিয়াউর রহমান, সাদ্দাম-বুশের যুদ্ধ। মক্কা-মদিনা, তাজমহল, মুজিব, ইন্দিরা গান্ধী এখনো আছে। সব সময় থাকে সমকালের ক্ষমতাসীন সরকার প্রধানের ছবি। এ জিনিসটা রাখতেই হয়। লেখাপড়া না জানলেও কী দেখাতে হবে, এটা খুব ভালোই বুঝতেন বায়স্কোপওয়ালারা। আর ওই যে, ‘কী চমৎকার দেখা গেল; আরো কিছু রইয়া গেল; তারা জ্যোতি চইলা গেছে; দেখতে কত বাহার আছে, এইবারেতে দেখেন ভালো, আপন রাজা সামনে আছে। তীর-ধনুক হাতে আছে। কত সৈন্য শহীদ হলো; পরিস্থানের পরি আছে; দেখতে কত বাহার আছে; ডানে বামে নজর করো; মদিনারই শহর আছে, নবী সাহেবের পাগড়ি আছে, নবী সাহেবের লাঠি আছে, আরবি দিয়ে লেখা আছে; এইবারেতে দেখেন ভালো মক্কা শরিফ সামনে আছে, কত হাজী হজ করিতে দেশের থেকে রওনা দেছে;’ আরও আছে দার্জিলিংয়ের পাহাড়, সুন্দরবনের বাঘ-ভাল্লুক। বাস্তবে সুন্দরবনে ভাল্লুক না থাকলেও গল্পকথায় বাঘের সঙ্গে ভাল্লুক থাকবেই। অবশেষে ‘কী চমৎকার দেখা গেল; তারা জ্যোতি চইলা গেল; অন্ধকার পইড়া রইল।’ থামলেন সেই বায়োস্কোপোয়ালা। বায়স্কোপ আর খুব ভালো চলে না এখন। তখনকার দর্শকদের স্মৃতি আর কৌতূহলেই রয়েগেলো সেই বায়স্কোপ। কৌতূহলে আর স্মৃতির টানে অনেকে এখনো খোঁজে। করতালের তালে তালে ‘কী সুন্দর দেখা গেলো’ ভাঙা কণ্ঠের এই শ্লোগান যেন মনে হলেই তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় স্বপ্নময় ধূসর শৈশবে। সান্তাহার এলাকায় বায়স্কোপ নিয়ে আর কেউ আসে না। তাতেই বোঝা যায়, বায়স্কোপ এখন বিলুপ্তির শেষ দ্বারপ্রান্তে। বর্তমান যুগে শুধু বায়স্কোপই নয় সিনেমা হলও তার জৈলুস হারিয়ে ফেলেছে। ঘরে ঘরে টেলিভিশন, ডিশ লাইনের আবির্ভাবে ছায়াছবি দর্শক অভাবে সম্প্রতি বন্ধু-বান্ধব এমনকি সপরিবারে বিনোদন উপভোগ করার অন্যতম মাধ্যম দেশের সিনেমা হলের একটি বড় অংশই ভেঙ্গে মার্কেট নির্মাণ করা হচ্ছে। জানান, আমাদের শৈশবকালে গল্প শুনতাম সিনেমা হলে প্রচন্ড ভিড় হতো। তাই গ্রামে বা স্থানীয় মেলায় বায়োস্কোপ দেখানো হতো। আর সেটা দেখে সিনেমার খোরাক মেটাতাম। এখনকার ছেলে মেয়েরা এ বিষয়ে খুব একটা জানে না। বিশেষ কিছু বলতেও পারবে না। নতুন প্রজন্মের এ বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই। তরুন প্রজন্মেররা বলেন, বায়স্কোপের গল্প শুধু এলকার মুরাব্বিদের কাছে থেকে শুনেছি কিন্তু আগে কখনো দেখিনি। শুনেছি মেলা হলে বায়স্কোপেওয়ালারা আসতো কিন্তু এলাকায় এখন তেমন একটা মেলাও বসেনা। এর একটি যেমন, বায়স্কোপ। বায়স্কোপ বললেই কত রংবেরঙের ছবি চোঁখে ভেসে ওঠে। জাদুর বাক্স বলেও ডাকত লোকে। তখন মানুষের বিনোদন বলতে ওই যাত্রা-সার্কাস। শীতের সময় দশ গ্রামের মধ্যে একটা কোনো বড় বাজারের ধারে অথবা ফাঁকা স্থানে প্যান্ডেল পড়ত কয়েক দিনের জন্য। সবার অবশ্য প্রবেশাধিকার ছিল না। ছোটরা তো নয়ই, বড়দেরও সবার অনুমতি ছিল না যাত্রা দেখার। তবে একটা জিনিসে সবার অধিকার ছিল। সেটি একটি লাল বাক্স। গামছা মাথায় আর হাতে করতাল নিয়ে অদ্ভুত একটা লোক হাজির হতো। তার গলা ভাঙা, কিন্তু বেশ সুরেলা। এসব মিলিয়ে বায়স্কোপ। বাক্সের সামনেও দুই পাশে চোঙার মতো কয়েকটি মুখ। প্রতিটি মুখে লাগানো থাকে উত্তাল লেন্স। আর বাক্সের ভেতর একপ্রান্ত কাপড়ে লাগানো থাকে ছবি। কাপড়টা পেঁচানো থাকে পাশের দুটি কাঠিতে। কাঠির ওপরের মাথায় বাক্সের বাইরে লাগানো থাকে একটা হ্যান্ডেল। এই হ্যান্ডেল ঘোরালে ছবিসহ কাপড়টা একপাশ থেকে গিয়ে আরেক পাশে পেঁচাতে থাকে। তখন চোঙায় চোঁখ লাগিয়ে দেখা যায় ছবিগুলো। লেন্সের সুবাদে ছবিগুলো দেখায় স্পষ্ট বড় আর বেশ কাছে। ছবির সঙ্গে সঙ্গে করতাল বাজিয়ে সুরে সুরে দেওয়া হয় ধারাবর্ণনা। এভাবে একবার বাঁ থেকে ডানে, ডান থেকে বাঁয়ে। প্রদর্শনীর পর মুড়ির টিনের মতো মুখা দিয়ে আটকে রাখা হয় মুখ। অভিধানে বায়স্কোপ শব্দের অর্থ চলচ্চিত্র, ছায়াছবি, সিনেমা বলা হলেও আমাদের দেশে বায়স্কোপ নামে যা প্রচলিত তার যাত্রা শুরু হয়েছিল আধুনিক সিনেমা বা চলচ্চিত্রেরও বেশ আগে। ফটো তোলার জন্য সেলুলয়েড ফিল্ম আবিষ্কারের পর চলমান বস্তু বা ব্যক্তির ছবি হুবহু তোলা সম্ভব হলো। তখন কতগুলো ছবি একটি ড্রামের ভেতর পর পর লাগিয়ে ড্রামটি ঘোরানো হতো আর ড্রামের একদিকে রাখা হতো দেখার ব্যবস্থা। এভাবেই চলা হয় বায়স্কোপের। আর এভাবেই ড্রাম থেকে আসে প্রজেক্টর আর পর্দা। ছবিগুলোর স্থান হয় প্রেক্ষাগৃহের বাক্স থেকে রুপালি পর্দায়। সাদাকালোর যুগ পেরিয়ে আসে রঙিন চলচ্চিত্র। সেদিক থেকে সিনেমা হলো বায়স্কোপের উত্তরসূরি। বায়স্কোপের ইতিহাস সূত্রে জানাযায়, বাংলায় বায়স্কোপ দেখানো শুরু হয় ১৮৯৬ সালে। উদ্যোক্তা ছিলেন বিদেশি। নাম স্টিফেন্স। একটি থিয়েটার দলের সঙ্গে এসেছিলেন কলকাতায়। তখন তিনিই কলকাতায় প্রথম দেখিয়ে যান বায়স্কোপ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here