নড়াইলের প্রভাবশালী জমিদারের রাজকন্যা অভয়ার নামে অভয়নগর গ্রাম!

0
402

উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি: ‘নড়াইলের জমিদার’ প্রভাবশালী জমিদার বংশের একজন নীলাম্বর রায়ের সাথে। অদৃষ্টের পরিহাসে বিয়ের অল্প কিছুদিন পরে নীলাম্বর রায় দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। কিছুদিন রোগভোগের পরে মারা যান নীলাম্বর রায়। বিধবা হন রাজকন্যা অভয়া। তিনি ছিলেন শৈব অর্থাৎ মহাদেব শিবের উপাসক। নড়াইলের সীমান্তবর্তী এলাকা অভয়নগর বলতে আমরা যে স্থানকে চিনি আগে সে স্থানটি অভয়নগর নামে পরিচিত ছিল না। এখানের নাম পূর্বে ছিল অভয়ানগর। আর অভয়া ছিলেন একজন রাজকন্যা এবং নড়াইলের জমিদার বংশের নীলাম্বর রায়ের পত্নী। অভয়নগর গ্রামটি ভৈরব নদের পাড়ে অবস্থিত এই সাদামাটা অভয়নগর সেই ইংরেজ আমলে কীভাবে বাংলাদেশের একেবারে প্রথম দিককার একটি থানা হয়ে উঠেছিল তা জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে আরো কয়েকশো বছর পূর্বে। মুঘলদের সাথে যুদ্ধে প্রতাপশালী যশোর রাজ্যের রাজা প্রতাপাদিত্য পরাজিত ও বন্দী হন। ফলে রাজ পরিবারের সদস্যরা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন ভাগ্যান্বেষণে। তাদের একজন ঠাঁই নিয়েছিলেন যশোরের চাচড়া অঞ্চলে। এদের উত্তরপুরুষ রাজা নীলকণ্ঠ রায়। পরিশ্রম করে নিজের ভাগ্য ফিরিয়েছিলেন। ধন-দৌলত আর শক্তি-সামর্থে সবার সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন তিনি। এই নীলকণ্ঠ রায়ের ঘর আলো করে জন্ম গ্রহণ করেছিলো এক কন্যাসন্তান। পিতা কন্যার নাম রাখলেন অভয়া। তখন বাংলায় চলছে এক ক্রান্তিকাল। এ অঞ্চলে জালের মতো বিস্তৃত শত শত নদ-নদী আর খাল-বিল। আরো দক্ষিণে এগিয়ে গেলে দুর্ভেদ্য সুন্দরবন। এই সুযোগ নিয়ে দুর্র্ধষ হার্মাদ জলদস্যুরা এই এলাকার মানুষের উপর চালাতো পাশবিক নির্যাতন। ধনসম্পদ লুটের পাশাপাশি নারী ও শিশুদের ধরে নিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিতো। তাদের দমন করার জন্য রাজা নীলকণ্ঠ রায় উদ্যোগ নিলেন। ভৈরব নদের তীরে হিন্দুদের একটি অতি প্রাচীন তীর্থস্থান ভাটপাড়া। ভাটপাড়ার পাশেই নদীর তীরে তিনি দুর্গ নির্মাণ করেন। তারপর রাজধানী চাচড়া থেকে এখানে সপরিবারে স্থানান্তরিত হলেন। এখানেই বেড়ে উঠতে লাগলেন রাজকন্যা অভয়া। প্রাপ্তবয়স্কা হলে অভয়ার বিয়ে ঠিক করা হয় সে সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী জমিদার ‘নড়াইল জমিদার’ বংশের একজন নীলাম্বর রায়ের সাথে। অদৃষ্টের পরিহাসে বিয়ের অল্প কিছুদিন পরে নীলাম্বর রায় দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। কিছুদিন রোগভোগের পরে মারা যান নীলাম্বর রায়। বিধবা হন রাজকন্যা অভয়া। অভয়া ছিলেন শৈব অর্থাৎ মহাদেব শিবের উপাসক। পিতার কাছে অনুরোধ করলেন, তিনি তার বাকি জীবন মহাদেবের আরাধনা করেই কাটিয়ে দিতে চান। নীলকন্ঠ রায় মেয়ের ইচ্ছা শুনে রাজবাড়ির সন্নিকটে মেয়ের জন্য মন্দির নির্মাণ করে দেন। একটি-দুটি নয়, ৬০ একর জায়গার উপর ১১টি শিব মন্দির নির্মাণ করেন তিনি। আর মেয়ের নাম অনুসারে নগরের নাম রাখেন অভয়ানগর, যা কালক্রমে পরিচয় পেয়েছে অভয়নগর নামে। ভৈরব নদের তীরে এখনো দাঁড়িয়ে আছে সেই স্থাপনা। এটি শুধুমাত্র একটি সুন্দর মন্দিরই নয়, একই স্থানে এতগুলো শিব মন্দির বাংলাদেশে আর কোথাও নেই। নড়াইলের সীমান্তবর্তী এলাকা নওয়াপাড়ার নুরবাগে বাস থেকে নেমে তারপর খেয়া নৌকায় ভৈরব নদী পার হয়ে ওপারে পৌঁছা যায়। এখান থেকে ইঞ্জিনচালিত ভ্যানগাড়ি, চাঁদের গাড়ি সদৃশ টেকার নামে স্থানীয়ভাবে পরিচিত গাড়ি, কিংবা ভাড়ায় মোটরসাইকেল পাওয়া যায়। মন্দির প্রাঙ্গণে পৌঁছাতে হলে সিংগাড়ি বাজার যেতে হবে। সেখান থেকে ভাটপাড়া বাজারে পৌছে ভৈরব নদকে অনুসরণ করতে হবে। ভৈরবের তীর দিয়ে ইটের সলিং বসানো রাস্তা নিয়ে যাবে কাক্সিক্ষত গন্তব্যে। মন্দিরের নির্মাণকাল ১৭৪৫-৬৪ সাল। মন্দির নির্মাণে ব্রিটিশ আমলে অনুসৃত চুন সুরকি এবং ইটের ব্যবহার করা হয়েছে। ইটের আকৃতি পাতলা ও বর্গাকার। চুন-সুরকির প্রলেপ ধরে রেখেছে ইটগুলোকে। পূর্ব ও পশ্চিম সারিতে চারটি করে মোট আটটি মন্দির। দক্ষিণ দিকে প্রবেশপথের দু’দিকে রয়েছে দুটি মন্দির। মূল মন্দিরটি পশ্চিম দিকে। সব মিলিয়ে এগারোটি মন্দির। প্রত্যেকটি মন্দির মাঝখানের উঠোনের দিকে মুখ করে অবস্থিত। মূল মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ২৪ ফুট ৪ ইঞ্চি আর প্রস্থ ২২ ফুট ৩ ইঞ্চি। দেয়ালের প্রস্থ ৩ ফুট ৪ ইঞ্চি। প্রত্যেকটি মন্দিরে আগে একটি করে শিবলিঙ্গ ছিলো, পরে চুরি হয়ে যায়। এখন শুধুমাত্র মূল মন্দিরেই একটি শিবলিঙ্গ অবশিষ্ট রয়েছে। আমাদের নড়াইল জেলা প্রতিনিধি উজ্জ্বল রায়ের রিপোটে, মন্দিরের বাইরে দক্ষিণ দিকে মন্দির কমপ্লেক্সে ঢোকার প্রধান প্রবেশপথ অবস্থিত। প্রতিটি মন্দিরে প্রবেশের জন্য আছে খিলানাকৃতির প্রবেশপথ ও উপপ্রবেশপথ, বাকানো ও কোণাকৃতির কার্ণিশ। আর রয়েছে অনিন্দ্যসুন্দর কারুকার্য। তার মধ্যে রয়েছে পদ্মসহ আরো অনেক চিত্রের মোটিফ। মন্দিরের বিশেষত্ব এটি স্থানীয় রীতিতে নির্মিত। সে সময়ে যে বাংলায় উন্নত মানের স্থাপত্যশিল্প বর্তমান ছিলো এটি তার প্রমাণ বহন করে চলেছে। ছাঁদগুলো নির্মিত হয়েছে উলম্ব ধরনের ডোমের সমন্বয়ে। অর্থাৎ দুই স্তরে নির্মিত ছাদের ভেতরে গোলাকার এবং বাইরে চালা রীতিতে নির্মিত। সবগুলো মন্দির নির্মাণে স্থানীয় উপকরণ, নির্মাণশৈলি এবং দক্ষতার ছাপ মেলে। মন্দিরের চারপাশে একসময় প্রাচীর বেষ্টিত ছিলো। এখনও তার চিহ্ন রয়েছে। উত্তর-পশ্চিম কোণে একটি পুকুর ছিলো। এখন সেটি দখলদারদের কবলে। আর রাজবাড়ি? সেখানে এখন পানের বরজ! রাজা নীলকণ্ঠ রায় প্রতিটি মন্দিরের জন্য দু’শ বিঘা নিষ্কর জমি দান করেছিলেন। এই জমি থেকে মন্দিরের খরচ উঠে আসতো। মন্দিরের ভোগ হওয়ার পরে ভক্তদের প্রসাদ বিলি করার পর পূজারী ব্রাহ্মণদের বাড়ি বাড়ি ভোগ পাঠানো হতো। দেশভাগের পর স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই ভারতে চলে যায়। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাকি যারা ছিলো তাদের বড় অংশ পুনরায় দেশত্যাগ করে। বড় মন্দিরে এখনো নিত্যপূজা হয়। মধ্যাহ্নপূজা দিতে উপস্থিত হন একজন পূজারিণী। তিনি স্থানীয় বারুই সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। তাদের পরিবারই ষাট বছর ধরে এখানে পূজো করে আসছেন। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ প্রত্যান্ত অধিদপ্তর প্রথম ধাপের সংস্কার কাজ আরম্ভ করে, যা শেষ হয় ২০১৭ সালে। এই সংস্কারের ফলে দৃষ্টিনন্দন এই স্থাপনা ধ্বংসের হাত থেকে আপাতত রেহাই পেয়েছে। সংস্কার কাজ শেষ হলে আশা এটি তার অনন্য রুপ ফিরে পাবে বলে প্রত্যাশা সকলের। অনিন্দ্য এই স্থাপনা আর পাশের স্বচ্ছসলিলা ভৈরব নদ পর্যটনের একটি চমৎকার আকর্ষণ হতে পারে। সেজন্য সরকারের পরিকল্পনার প্রয়োজন। কালের বাধা পেরিয়ে টিকে থাকা বহু স্মৃতির আঁধার এই মন্দির। সবকিছু হারিয়ে এক রাজকন্যার নিজের আরাধ্য দেবতার কাছে আশ্রয়ের জন্য স্থাপিত হয়েছিলো যে মন্দির! সবাই আজ হারিয়ে গেছে! শুধু টিকে আছে মন্দির! এটাই কালের নীতি! মানুষ হারিয়ে যায়, টিকে থাকে তার কীর্তি। জমিদার প্রথা বিলুপ্ত হলেও দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে জমিদারদের অসংখ্য বংশধর। ঠিক তেমনি নড়াইলে কর্মরত গণমাধ্যমকর্মী উজ্জ্বল রায়ও নড়াইলের জমিদারদের শেষ বংশধর। তাঁর ঠাকুমা কালের পরিক্রমায় রাজবাড়িতে স্থানান্তরিত হলেও তিনি আবার ফিরে এসেছেন তার বংশের স্মৃতিবিজড়িত পূণ্যভূমি নড়াইলে। তাইতো নড়াইলবাসীর কল্যাণে তিনি সর্বদা
খবর ৭১/ইঃ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here