নুসরাত হত্যা মামলার চার্জশিট চূড়ান্ত, দাখিল দুপুরে

0
472

খবর৭১ঃ বহুল আলোচিত ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা ও আওয়ামী লীগের দুই স্থানীয় নেতাসহ মোট ১৬ জনের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এদের বিরুদ্ধে আজ বুধবার দুপুরে আদালতে চার্জশিট জমা দেয়া হবে। এতে প্রত্যেক আসামির মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হয়েছে। অধ্যক্ষ সিরাজকে আসামি করা হয়েছে নুসরাতকে হত্যার ‘হুকুমদাতা’ হিসেবে।

গতকাল মঙ্গলবার সকালে ধানমন্ডিতে পিবিআই সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছেন মামলার তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান বনজ কুমার মজুমদার। ৭২২ পৃষ্ঠার এ চার্জশিটে সাক্ষী করা হয়েছে ৯২ জনকে। তাদের মধ্যে ৭ জন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। আর আসামিদের মধ্যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন ১২ জন। পিবিআই প্রধান বলেন, নুসরাত মাদ্রাসার সব অপকর্মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল। তাই সবাই মিলে নূসরাতকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে পরস্পর লাভবান হওয়ার জন্য। এই মামলায় আমরা ১৬ আসামির সবার মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাশা করছি।

১৬ আসামির মৃত্যুদণ্ড চেয়ে চার্জশিট চূড়ান্ত সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা, নূর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ আলম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ, হাফেজ আব্দুল কাদের, আবছার উদ্দিন, কামরুন নাহার মনি, অধ্যক্ষের ভাগ্নি উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা, আব্দুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন ওরফে মামুন, মোহাম্মদ শামীম, মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীন ও মহিউদ্দিন শাকিল। এই ১৬ আসামির মধ্যে ৩ জন নুসরাতের সহপাঠী। এরা হলেন- কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা পপি ও জাবেদ হোসেন। এছাড়া শাহাদাত হোসেন ও জোবায়ের আহমেদ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেন বলে উঠে এসেছে আসামিদের জবানবন্দি ও পিবিআইয়ের তদন্তে।

পিবিআই প্রধান যা বললেন

সংবাদ সম্মেলনে নুসরাততে নৃসংশভাবে পুড়িয়ে হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা করতে গিয়ে পিবিআই প্রধান বনজ কুমার বলেন, তারা কতটা দৃঢ়তার সঙ্গে এমন নৃসংশতা করেছে এটা ভাবাই যায় না। আমরা সকলেই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে এ ঘটনায় জড়িতরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে যা সবাই দেখবে। আর এর জন্য সকল প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি। আশা করছি আদালত দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন।

তিনি বলেন, নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার ঘটনায় সরাসরি পাঁচজনের জড়িত থাকার বিষয়ে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। নুসরাত হত্যায় মোট ১৬ জন জড়িত বলে তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণ মিলেছে। এদের মধ্যে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে আসামি করা হচ্ছে নুসরাতকে হত্যার ‘হুকুমদাতা’ হিসেবে। মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীন এবং সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ আলম হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে আর্থিক সহযোগিতাসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন বলে উল্লেখ থাকছে পিবিআইয়ের চার্জশিটে।
বনজ কুমার বলেন, ঠান্ডা মাথায় এই হত্যায় চারটি শ্রেণি-পেশার মানুষকে অংশ নিতে দেখা যায়। এরা হলো শিক্ষক, রাজনৈতিক ব্যক্তি, স্থানীয় সরকার প্রশাসন এবং শিক্ষার্থী। খুনের পর নুসরাতের তিন সহপাঠী পরীক্ষার হলে ঢুকে ঠান্ডা মাথায় পরীক্ষা দেয়, যা ভাবনাতীত। এ ঘটনা শিক্ষণীয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি। পিবিআই প্রধান বলেন, ‘নুসরাত জাহান রাফি অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় নিচে নেমে আসার সময় দুঃখজনক হলেও সত্য যে শরীরে কাপড় দেখা যায়নি, পুড়ে গেছে। এ সময় শরীর থেকে মাংস খুলে খুলে পড়ছিল।’

যে ধারায় চার্জশিট পিবিআইর তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তদন্তে মোট ১৬ জন আসামির বিরুদ্ধে নুসরাত জাহান রাফিকে অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করা এবং হত্যার পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ ও হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করার অপরাধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর ৪(১) ও ৩০ ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।

ধারা ৪ (১) এ বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি দহনকারী, ক্ষয়কারী অথবা বিষাক্ত পদার্থ দ্বারা কোনো শিশু বা নারীর মৃত্যু ঘটান বা মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করেন, তাহা হইলে উক্ত ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন এবং ইহার অতিরিক্ত অনূর্ধ্ব এক লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডনীয় হইবেন।’

ধারা ৩০ এ বলা আছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা যোগান এবং সেই প্ররোচনার ফলে উক্ত অপরাধ সংঘটিত হয় বা অপরাধটি সংঘটনের চেষ্টা করা হয় বা কোনো ব্যক্তি যদি অন্য কোনো ব্যক্তিকে এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটনে সহায়তা করেন, তাহা হইলে ওই অপরাধ সংঘটনের জন্য বা অপরাধটি সংঘটনের চেষ্টার জন্য নির্ধারিত দণ্ডে প্ররোচনাকারী বা সহায়তাকারী ব্যক্তি দণ্ডনীয় হইবেন।’

মামলার আলামত নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার জন্য কেরোসিন তেল বহনের কাজে ব্যবহূত পলিথিন, নুসরাতের গায়ে সেই কেরোসিন ছিটানোর কাজে ব্যবহূত একটি কাচের গ্লাস, দেশলাইয়ের কাঠি, তিনটি কালো রঙের বোরকা, আসামি শামীমের ব্যবহূত একটি মোবাইল ফোন ও আসামি রুহুল আমীনের সঙ্গে তার কথপোকথনের রেকর্ড এবং অধ্যক্ষের অপকর্মের বিবরণ লেখা নুসরাত জাহান রাফির ডায়েরি এ মামলার আলামত হিসেবে আদালতে উপস্থাপন করা হবে।

যেভাবে নুসরাতকে হত্যা চলতি বছরের ২৭ মার্চ অধ্যক্ষের নিপীড়নের ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। এরপর গত ৬ এপ্রিল সকালে নুসরাত আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় যান। এ সময় মাদ্রাসার এক ছাত্রী তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদের ওপর কেউ মারধর করছে- এমন সংবাদ দিলে তিনি ওই ভবনের চার তলায় যান। সেখানে মুখোশ পরা চার-পাঁচজন তাকে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগ তুলে নিতে চাপ দেয়। রাফি অস্বীকৃতি জানালে তারা তার গায়ে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়। গত ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান নুসরাত জাহান রাফি।

এদিকে এরইমধ্যে নুসরাত জাহান রাফির জবানবন্দির ভিডিও ধারণ ও তা ফেসবুকে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে ঢাকার একটি আদালত। আগামী ১৭ জুন গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিলের দিন ধার্য করা হয়েছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here