দেশকে এমনভাবে গড়ব যাতে বিশ্ব বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে

0
298

খবর৭১ঃপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশকে এমনভাবে গড়ে তুলব যাতে বিশ্ববাসী বিস্ময়ে বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে থাকে। কারণ আমার বাবা বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য আজীবন কাজ করেছেন। আমার মা কষ্ট করেছেন। আমিও দিনরাত পরিশ্রম করছি। আমার আর কোনো কিছু চাওয়ার নেই। ধন-সম্পদের প্রয়োজন নেই। বীরের জাতি হিসেবে আমরা বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই। ঘুরে দাঁড়াতে চাই। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রথম টানেল নির্মাণ হচ্ছে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে। এটা সরকারের অনেক বড় সাফল্য। এর মাধ্যমে উন্নয়নের নতুন ধাপে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ।

রোববার চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল (সুড়ঙ্গ পথ) নির্মাণের বোরিং (খনন) কাজের উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজিত সুধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই টানেলের মাধ্যমে চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থার যেমন উন্নয়ন হবে, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। ব্যাপকভাবে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধিত হবে। টানেলের মাধ্যমে চট্টগ্রামের সঙ্গে কক্সবাজারের সংযোগ ঘটবে। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়বে। বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো এগিয়ে এসেছে বলেই আমি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছি।

তিনি আরও বলেন, ‘পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক অপমানিত হয়েছি। দুটি পত্রিকার সম্পাদক কাম-মালিক ও আপনাদের চট্টগ্রামের মানুষ একজন সুদখোর মিলে পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক প্রপাগান্ডা ছড়িয়েছেন। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিল। আমাকে পর্যন্ত দুর্নীতিবাজ ও দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ হিসেবে প্রমাণিত করার অনেক অপচেষ্টা হয়েছিল। কানাডার আদালতে মামলা করা হয় পদ্মা সেতুর ‘দুর্নীতি’ নিয়ে। সেই মামলাও খারিজ হয়ে যায়। এতটুকু দুর্নীতি প্রমাণ করতে পারেনি তারা। একে গ্রেফতার কর, ওকে ধর- এ ধরনের নানা শর্ত দিয়ে বলেছিল, তাহলেই পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করব। বিশ্বব্যাংকের এসব কথা না শুনে শেষ পর্যন্ত নিজেদের অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণ করার ঘোষণা দিয়েছিলাম। এখন সেই পদ্মা সেতু নির্মাণ হচ্ছে। আমার নামে পদ্মা সেতুর নামকরণ করার প্রস্তাব করা হলেও আমি তাতে সায় দেইনি। কারণ আমি নামের জন্য নয়; দেশের মানুষের জন্যই কাজ করতে চাই।’

প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে একজন মানুষও যাতে গৃহহারা না থাকে, সবার দ্বারে দ্বারে যাতে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেয়া যায়, বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়া যায়- সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যাচ্ছি। গ্রাম থেকে উন্নয়ন করছি। বাংলাদেশের জিডিপি ডাবল ডিজিটে উন্নীত করা হবে। আমরা ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ নামে শতবর্ষের পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি। ২০২০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করব। মুজিব বর্ষ ঘোষণা করেছি। ২০৭১ সালে স্বাধীনতার শতবর্ষ। তত দিন হয়তো আমি বাঁচব না। আমাদের প্রজন্ম উন্নত, সমৃদ্ধশালী দেশে তা উদযাপন করবে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীকে স্মরণ করে বলেন, ‘টানেল নির্মাণের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যদি মহিউদ্দিন চৌধুরী উপস্থিত থাকতেন তবে তিনিই সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। কারণ মহিউদ্দিন চৌধুরীই কর্ণফুলীতে টানেল নির্মাণের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। নদীর ওপরে সেতু হলে নদী নব্যতা হারায়। পলি জমে। এ কারণেই তার প্রস্তাব ছিল নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেলা ১১টায় পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের বোরিং (খনন) কাজের উদ্বোধন ঘোষণা করেন। এরপর তিনি লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত দেশের প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও সুধী সমাবেশে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, পূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, হুইপ সামশুল হক চৌধুরী, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সুধী সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য দেন সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, স্বাধীনতার পর জাতির পিতা মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন। এর মধ্যে তিনি একটি সংবিধান দিয়ে গেছেন। একটা দেশ কীভাবে চলবে, তার পুরো দিকনির্দেশনা ছিল সেই সংবিধানে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলেন। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর চালু করেন। এখানে অনেক মাইন পোঁতা ছিল। সেগুলো রাশিয়াসহ বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সহায়তায় সরানোর ব্যবস্থা করা হয়। বন্দর সচল করা হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে। স্বজনহারার বেদনা নিয়ে ৬টি বছর বিদেশে কাটিয়েছি। আমার বোন রেহানার পাসপোর্টটি পর্যন্ত নিয়ে ফেলেছিলেন জিয়াউর রহমান।

সুধী সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের আকাশচুম্বী উন্নয়ন সাধন করে নিজেকেই অতিক্রম করে গেছেন। বিগত ৪৩ বছরে সৎ ও সাহসী রাজনীতিকের নাম শেখ হাসিনা। সফল কূটনীতিকের নাম শেখ হাসিনা। তিনি স্বপ্ন নিয়ে জেগে আছেন বলেই বাংলাদেশ নিশ্চিন্তে ঘুমায়। চট্টগ্রামবাসীর অনুরোধ ছিল কর্ণফুলী টানেল যাতে শেখ হাসিনার নামে হয়। কিন্তু এর আগে পদ্মা সেতুর নাম প্রধানমন্ত্রীর নামে করার প্রস্তাব পাঠালে তাতে তিনি রাজি হননি। এজন্য বঙ্গবন্ধুর নামেই কর্ণফুলী টানেলের নামকরণ করার প্রস্তাব পাঠিয়েছিলেন ভয়ে ভয়ে। কর্ণফুলীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নির্মাণ ২০২২ সালে সমাপ্ত হবে। টানেল হলে সাংহাই সিটির আদলে কর্ণফুলীর এপার-ওপারে গড়ে উঠবে দুটি শহর। টানেলের মাধ্যমে আনোয়ারা-পটিয়া বাইপাস হয়ে কক্সবাজারের সঙ্গে গড়ে উঠবে সংযোগ। মিরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণ ও চট্টগ্রামে মেট্রো রেল চালুর চিন্তাভাবনাও আছে সরকারের।

সেতু বিভাগের সিনিয়র সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম স্বাগত বক্তব্যে বলেন, ‘টানেল নির্মাণের পুরো কৃতিত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তার দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও নেতৃত্বের গুণেই চীন সরকারের কাছ থেকে তাদের শতভাগ অর্থায়নে কর্ণফুলীতে টানেল নির্মাণ চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। তিন দিনের সফরে দেখা গেছে, সকালে চুক্তি করার কথা বলে তো দুপুরে কথা থেকে সরে যায় চীন। আবার বিকালে রাজি হয় তো রাতে সরে যায়। শেষ পর্যন্ত দুই ঘণ্টার মধ্যেই চীন সরকারের প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীসহ দায়িত্বশীলদের উপস্থিতিতে টানেল নির্মাণ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। যা ছিল একটি বিস্ময়কর ও আনন্দদায়ক ঘটনা।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল : কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মিতব্য মূল টানেলটি হবে ২টি টিউব সংবলিত এবং ৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ। টানেলের পূর্ব ও পশ্চিম পাশে ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ রোড ও ৭২৭ মিটার ওভারব্রিজসহ এই টানেলটি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলাকে শহরাঞ্চলের সঙ্গে সংযুক্ত করবে। এর নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৮৮০ দশমিক ৪০ কোটি টাকা। ২০২২ সালের মধ্যে টানেলের কাজ শেষ করার কথা রয়েছে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উদ্বোধন হওয়া অপর প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পর্যন্ত ১৬ দশমিক ৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ২৫০ কোটি টাকা। ২০২০ সাল পর্যন্ত এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে। এটি বাস্তবায়ন হলে নগরীর যানজট নিরসনের পাশাপাশি পতেঙ্গায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটবে।
খবর৭১/ইঃ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here