বাবা ও ফুফু হত্যার প্রতিশোধ নিতে নড়াইলের আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা

0
238

উজ্জ্বল রায়, নড়াইল জেলা প্রতিনিধি: বাবা ও ফুফু হত্যার প্রতিশোধ নিতে পলাশ হত্যাকান্ড ॥ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গুলিতে নয়; পলাশকে কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয় ॥ হত্যাকান্ডে অংশ নেয়া চারজন, হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ছুরি উদ্ধার ।৬ মাস ধরে ইউপি চেয়ারম্যান পলাশকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। নড়াইলের উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক ও দিঘলিয়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান পলাশ (৪৮) হত্যার নেপথ্য কাহিনী বেরিয়ে এসেছে। মোবাইল মেসেজের সূত্র ধরে  হয়েছে হত্যা রহস্য। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার এবং লোহাগড়ার কুমড়ি গ্রামের সৈয়দ আল আমিনের বাবা ইলিয়াস আলী হত্যা ও শান্ত শেখের ফুফু তথা নিহত পলাশের প্রথম স্ত্রী মদিনা বেগম হত্যার অভিযোগে প্রকাশ্য দিবালোকে উপজেলা পরিষদ চত্বরে পলাশকে কুপিয়ে হত্যা করে চিহিৃত দুর্বৃত্তরা। এ সময় দুর্বৃত্তরা চার রাউন্ড গুলি ছুঁড়লেও তা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়।
পলাশ হত্যাকান্ডের ঘটনায় প্রশাসনসহ রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। হত্যা রহস্য উদঘাটনে নড়েচড়ে বসে পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। হত্যাকান্ডের নেপথ্যকাহিনী বের করতে মামলাটি তদারকির দায়িত্ব পায় নড়াইলের সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) মেহেদী হাসান। হত্যাকান্ডের ১৫দিনের মধ্যে মোবাইল মেসেজের সূত্র ধরে আলোচিত এ হত্যাকান্ডের পুরো ঘটনা বেরিয়ে আসে। হত্যাকান্ডে অংশ নেয়া চারজনকে সনাক্ত করে পুলিশ। এদিকে, পলাশ হত্যাকান্ডের ছয়মাস অতিবাহিত হলেও এ মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়া হয়নি।
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ ফেব্রুয়ারি হত্যাকান্ডের দিন পলাশকে দিঘলিয়া থেকে উপজেলা সদরে আসার পথিমধ্যে তিনটি স্থানে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু পলাশ মোটরসাইকেলযোগে দ্রুতগতিতে লোহাগড়ায় আসেন। এরপর চিহিৃত দুর্বৃত্তরা লোহাগড়া উপজেলা পরিষদের ভেতরে পুরানো সেটেলমেন্ট অফিসের কাছে অবস্থান নিয়ে ইউপি চেয়ারম্যান পলাশের গতিবিধি লক্ষ্য করেন। পলাশ লোহাগড়ায় এসে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) সঙ্গে দাপ্তরিক কাজ করেন। এক পর্যায়ে অফিস থেকে বের হলে ওৎপেতে থাকা সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পলাশকে ওই স্থানে (সেটেলমেন্ট অফিস) কুপিয়ে হত্যা করে।
পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা যায়, পলাশ হত্যাকান্ডে অংশ নেয় লোহাগড়ার কুমড়ি পশ্চিমপাড়ার মৃত সৈয়দ ইলিয়াস আলীর ছেলে সৈয়দ আল আমিন (২৭), পনিরুল ইসলামের ছেলে শান্ত শেখ (২২) ও সৈয়দ আলী আহম্মেদের ছেলে সৈয়দ রোমান আলী (২২) এবং গোপীনাথপুরের মফিজার শেখের ছেলে গোলাম কিবরিয়া (২৩)। এ চারজন এজাহারভূক্ত আসামি না হলেও মোবাইল মেসেজের সূত্র ধরে পলাশ হত্যাকান্ডে তাদের সরাসরি সম্পৃক্তার কথা বেরিয়ে এসেছে। সহকারী পুলিশ সুপার মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে গত ২২ মার্চ গোলাম কিবরিয়াকে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট, ২৩ মার্চ রোমানকে নারায়নগঞ্জের আলীগঞ্জ এবং ২৪ মার্চ আল আমিনকে ঢাকার বেগুনবাড়িয়া এলাকা থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর ২৫ মার্চ লোহাগড়া আমলি আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নয়ন বড়ালের আদালতে আল আমিন, গোলাম কিবরিয়া ও রোমান ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে পলাশ হত্যার কথা স্বীকার করেন এবং শান্ত শেখের সম্পৃক্ততার কথা জানায়।
সৈয়দ রোমান ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দিতে বলেন, গ্রাম্য দলাদলি নিয়ে পলাশ চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমাদের দুরত্ব ছিল। এ কারণে গত ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে কিবরিয়ার বাসায় বসে পলাশকে হত্যার পরিকল্পনা করি। ঘটনার সময় ছুরি দিয়ে পলাশকে কুপিয়ে জখম করি। আল আমিন বলেন, পলাশ চেয়ারম্যান তিন বছর আগে আমার বাবাকে (ইলিয়াস আলী) গুলি করে হত্যা করেছিলো। এছাড়া ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পলাশের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল। বাবা হত্যার প্রতিশোধ নিতে পলাশকে কুপিয়ে জখম করি। কিবরিয়ার ছোঁড়া একটি গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে আমার ডান হাতের আঙ্গুলে লাগে। গোলাম কিবরিয়া বলেন, পলাশকে হত্যার জন্য আল আমিন ও শান্ত আমাকে টাকার প্রলোভন দেখায়। বিষয়টি আমি পলাশ চেয়ারম্যানকে মোবাইল ফোনে মেসেজের মাধ্যমে জানিয়ে সর্তক করেছিলাম, ‘মামা (পলাশ) জীবন হুমকি স্বরূপ’। আমি অসুস্থ থাকায় এবং চাকুরি নিয়ে হতাশাগ্রস্থ হয়ে টাকার লোভে হত্যাকান্ডে অংশ নিই। আমি দু’টি গুলি করি। শান্তও পর পর দু’টি গুলি করে। গুলিগুলো লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যায়। সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন থেকেও জানা গেছে, লতিফুর রহমান পলাশ গুলিতে নয়; ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন। এছাড়া হত্যাকান্ডে অংশ নেয়া চারজনের কোনো মুখোশ পরা ছিল না বলেও পুলিশকে জানিয়েছে তারা।
এ ব্যাপারে মামলার তদারকি কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার মেহেদী হাসান বলেন, পলাশ হত্যা মামলাটি নিয়ে নড়াইল যখন উত্তাল; ঠিক সেই মুহুর্তে পুলিশ সুপারের নির্দেশে মামলার তদারকির দায়িত্ব পাই। অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করে প্রযুক্তি ব্যবহার করে হত্যাকান্ডে জড়িতদের চিহিৃত করার চেষ্টা করি। পাশাপাশি তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, গ্রাম্য দলাদলি, পারিবারিক শক্রতা, রাজনৈতিক প্রতিন্দ্বন্দ্বিতার বিষয়গুলো মূল্যায়ন করে হত্যা রহস্য উদঘাটনে কাজ শুরু করি। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা পলাশের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের মেসেজের সূত্র ধরে প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে হত্যাকান্ডে অংশ নেয়া আল আমিন, গোলাম কিবরিয়া ও সৈয়দ রোমান আলীকে গ্রেফতার করা হয়। এ হত্যাকান্ডে জড়িত শান্তকেও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। এছাড়া হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত একটি ছুরি ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এর আগে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি এ মামলার প্রধান আসামি জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্মসম্পাদক শরীফ মনিরুজ্জামান মনিকে ঢাকার গুলশান এলাকার একটি আবাসিক হোটেল থেকে গ্রেফতার করা হয়।
এ ব্যাপারে মামলার বাদী জেলা পরিষদ সদস্য সাইফুর রহমান হিলু বলেন, এজাহারভূক্ত সব আসামি এখনো গ্রেফতার হয়নি। তারা বিভিন্ন সময় আমাদের হুমকি দিচ্ছে। এছাড়া ছয়মাস অতিবাহিত হলেও চার্জশিট দেয়া হয়নি। আসামিপক্ষের স ম ওহিদুর রহমান বলেন, পলাশ হত্যাকান্ড ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে আমাদের আসামি করা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে  পলাশ হত্যায় চারজন সরাসরি জড়িত বলে তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। কেবলমাত্র হয়রানি করার জন্য ১৫জনকে আসামি করা হয়েছে। আর বাদীপক্ষকে হুমকি দেয়ার অভিযোগ ভিত্তিহীন। এ হত্যাকান্ডে জড়িত প্রকৃত খুনিদের নামে চার্জশিট দেয়ার দাবি জানান তিনি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুল ইসলাম বলেন, অধিকতর তদন্ত শেষে চাঞ্চল্যকর পলাশ হত্যা মামলার অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দেয়া হবে। আর বাদীপক্ষকে হুমকির বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে নড়াইলের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, (পপিএম)নড়াইল জেলা অনলাইন মিডিয়া ক্লাবের সভাপতি ও এ প্রতিবেদক উজ্জ্বল রায়কে জানান,ইউপি চেয়ারম্যান পলাশ হত্যা মামলাটি প্রথম থেকেই গুরুত্ব সহকারে দেখা হয়েছে। সহকারী পুলিশ সুপার মেহেদী হাসান পলাশ হত্যার মূল রহস্য উদঘাটন করে আসামিদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছেন। পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃত তিনজন পলাশ হত্যার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্ধিও দিয়েছেন। প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পলাশ হত্যাকান্ডে অংশ নেয়া তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। অপরাধ বিশ্লেষকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ বলেন, পুলিশের আন্তরিকতা এবং প্রযুক্তির কল্যাণে এ হত্যাকান্ডে জড়িতদের চিহিৃত করা সম্ভব হয়েছে।
জানা যায়, লোহাগড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের শ্রম বিষয়ক সম্পাদক ও দিঘলিয়া ইউপি চেয়ারম্যান কুমড়ি গ্রামের সন্তান লতিফুর রহমান পলাশকে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি দিনেদুপুরে লোহাগড়া উপজেলা পরিষদ চত্বরে হত্যা করা হয়। এরপর গত ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে নিহত পলাশের বড় সাইফুর রহমান হিলু বাদী হয়ে জেলা আ’লীগের যুগ্মসম্পাদক শরীফ মনিরুজ্জামান মনি, লোহাগড়া উপজেলা আ’লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুদুজ্জামান মাসুদ, দিঘলিয়া ইউনিয়ন আ’লীগ সভাপতি স ম ওহিদুর রহমানসহ ১৫জনের নামে মামলা দায়ের করেন। এজাহারভূক্ত ১৫ আসামির মধ্যে চারজন পলাতক এবং অন্যরা জামিনে আছেন।
খবর ৭১/ই:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here