দণ্ডিত হলেও ভোটের সুযোগ ‘থাকছে’ খালেদা জিয়ার

0
333

খবর৭১: দুর্নীতির মামলায় বেগম খালেদা জিয়ার দুই বছরের বেশি সাজা হলে তিনি জাতীয় নির্বাচনের জন্য অযোগ্য হবেন কি না- এ নিয়ে আইনি বিতর্ক শুরু হয়েছে এরই মধ্যে। তবে বিচারিক আদালতে সাজা হওয়ার পরও উচ্চ আদালতের নির্দেশেই ভোটে দাঁড়িয়ে সংসদ সদস্য হওয়ার উদাহরণ আছে।

আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণা হওয়ার কথা আছে। এই রায় রায়কে সামনে রেখে বিএনপিতে উদ্বেগ স্পষ্ট। বিএনপির আশঙ্কা, খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে তাকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে চায় সরকার।

রায় কী হবে, সেটি জানার সুযোগ নেই আগে। তবে মামলার বাদী দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী তথা রাষ্ট্রপক্ষ এই মামলায় খালেদা জিয়ার সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড চেয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ মনে করে যে অভিযোগ আনা হয়েছে বিএনপি নেত্রীর বিরুদ্ধে তার সবই প্রমাণ হয়েছে। তবে খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের দাবি উল্টো। তারা বলছেন, আদালতে প্রমাণ হয়নি কিছুই।

এখন খালেদা জিয়া যদি খালাস পান অভিযোগ থেকে, তাহলে আগামী নির্বাচনে তার লড়াইয়ের যোগ্যতা নিয়ে আলোচনা থেমে যাবে সেখানেই। তবে যদি তার দুই বছরের বেশি সাজা হয় তাহলে?

এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগপন্থী ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের মধ্যে দুটি মত। বিএনপিপন্থীরা বলছেন, বিচারিক আদালতে সাজা হলে এর বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। আর আপিল মঞ্জুর হলে সাজা স্থগিত হবে। সে ক্ষেত্রে খালেদা জিয়ার নির্বাচনে বাধা থাকবে না।

তবে সরকারপন্থী আইনজীবীরা বলছেন, আপিল গ্রহণের পর সাজা স্থগিত হলে সেটা বাতিল হয়ে যায় না। কাজেই দুই বছরের সাজা হলে ভোটে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই।

অবশ্য বিচারিক আদালতে সাজা হওয়ার পরও বাংলাদেশে ভোটে দাঁড়ানোর উদাহরণ আছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনেই চাঁদপুরের একটি আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের মহীউদ্দীন খান আলমগীর। পাঁচ বছর সংসদ সদস্য থাকার পর ২০১৪ সালের নির্বাচনে তিনি আবার সংসদ সদস্য হয়েছেন।

আবার বিচারিক আদালতে সাজার বিরুদ্ধে হাইকোর্টের খালাসের রায় আপিল বিভাগ বাতিল করে আবার শুনানির নির্দেশ দেয়ার পরও সংসদ সদস্য পদ বা মন্ত্রিত্ব-কোনোটাই অবৈধ হয়নি মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার।

যে বিধানের কারণে বিএনপিতে উদ্বেগ-বিতর্ক

সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদে সংসদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতার বিষয়ে বলা হয়েছে, যদি কেউ নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছরকাল অতিবাহিত না হয়ে থাকে, তবে তিনি সংসদ সদস্য থাকার যোগ্য হবেন না।

২০০৮ সালে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা যে মামলায় বিচার হচ্ছে, তার সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করা বিএনপির আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ এখনও নিশ্চিত নয়। তারপরও দলের চেয়ারপারসনের নির্বাচন করার আইনি যোগ্যতা থাকে কি না, এ নিয়ে কৌতুহল আছে।

বিদেশে অর্থপাচারের এক মামলায় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের সাত বছরের কারাদণ্ড এবং ২০ কোটি টাকা জরিমানার আদেশ এসেছে আপিল বিভাগ থেকে। ফলে তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হয়ে গেছেন। এখন খালেদা জিয়ারও যদি একই পরিণতি হয়, তাহলে বিএনপির জন্য বিষয়টি সুখকর হবে না।

সাজার আশঙ্কা আদালতেই করেছেন খালেদা

দুর্নীতির মামলায় সাজা হতে পারে, আদালতে এমন আশঙ্কার কথা বলেছেন খালেদা জিয়া নিজেই। গত ২ নভেম্বর আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে দেয়া বক্তব্যে তিনি বলেন. ‘অসৎ উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে সরিয়ে দেওয়া এবং নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করতে ক্ষমতাসীনরা একটি নীল নকশা প্রণয়ন করেছে। ’

৯ নভেম্বর আদালতে খালেদা জিয়া আবার বলেন, ‘শাসক মহলের ইচ্ছে অনুযায়ী আমাদের বিরুদ্ধে কোন একটা রায় দেওয়া হবে।’

সাজা হলে খালেদা নির্বাচন করতে পারবেন কি?

খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলছেন, তাদের নেত্রীর আশঙ্কা অনুযায়ী এই মামলার রায় তাদের বিরুদ্ধে গেলে উচ্চ আদালতে অবশ্যই আপিল করা হবে। আর জাতীয় নির্বাচনের আগে এই মামলার মীমাংসা উচ্চ আদালতে হয়ে যাবে বলে তারা মনে করেন না। ফলে বিচারিক আদালতের রায় বিরুদ্ধে গেলেও নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে কোনো শঙ্কা থাকার কারণ নেই।

খালেদা জিয়ার আইনজীবী আবদুর রেজ্জাক খান ঢাকাটাইমসকে বলেন, বিচারিক আদালতে সাজা হলেও বিএনপি নেত্রী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।

কীভাবে নির্বাচন করতে পারবেন- এমন প্রশ্নে রেজ্জাক খান বলেন, ‘তাকে সাজা দেয়া হলে আমরা অবশ্যই আপিল করব। আর ফৌজদারি কার্যবিধির ৪২৬ ধারায় আছে, কনভিকশন অ্যান্ড সেনটেন্স (দণ্ড ও সাজা) সাসপেন্ড হলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন।’

তবে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন,খালেদা জিয়ার সাজা হলে তাকে জেলে যেতে হবে। জেলে থেকে তাকে রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করতে হবে। সেখানে রায় যদি স্থগিত না হয় তাহলে তিনি নির্বাচন করতে পারবেন না। আর রায় যদি স্থগিত হয়ে যায় তাহলে তিনি নির্বাচন করতে পারবেন। নির্বাচিত হওয়ার পর যদি তার এই রায় যদি আপিলে বহাল থাকে তাহলে তার সংসদ পদ বাতিল হয়ে যাবে।’

জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার সাজা হবে কি হবে না সেটা এখনই বলা যাবে না। যদি সাজা হয় তাহলে তিনি নির্বাচন করতে পারবেন কি না আদালতই সিদ্ধান্ত দেবে।’

এর আগেও বিভিন্ন সময় বিচারিক আদালতে দণ্ডিতের ভোটে অংশ নেয়ার উদাহরণের বিষয়ে জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেন, ‘বিচারিক আদালতের দেয়া সাজা উচ্চ আদালতে স্থগিত হয়ে গেলে আমাদের দেশে সে নির্বাচন করতে পারেন। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, যত দিন পর্যন্ত সাজার বিষয়টি নিষ্পত্তি না হবে তত দিন তিনি নির্বাচনে অযোগ্য হবেন।’

বিচারিক আদালতে দণ্ডিত হয়েও ভোটের লড়াই

সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দণ্ডিত হয়েও ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে লড়াই করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা মহীউদ্দীন খান আলমগীর।

২০০৭ সালের ২৬ জুলাই অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে করা মামলায় ১৩ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল এই আওয়ামী লীগ নেতার। পরে এই সাজার বিরুদ্ধে আপিল করেন।

এই অবস্থায় ২০০৮ সালের ৩ ডিসেম্বর চাঁদপুর জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা জনাব আলমগীরের মনোনয়নপত্র বাতিল করে দেন। এই আদেশের বিরুদ্ধে তিনি নির্বাচন কমিশনে আপিল করেন। ৮ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশনও তার মনোনয়নপত্র বাতিল করে দেয়। পরে তিনি হাইকোর্টে রিট আবেদন দাখিল করেন। ১৫ ডিসেম্বর হাইকোর্টে রিট খারিজ করে দেয়।

এরপর আপিল বিভাগে যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর। আর চেম্বার জজ অন্তবর্তীকালীন আদেশে হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন। ফলে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ পান তিনি। নির্বাচনে জয়ী হন ম খা আলমগীর।

নির্বাচনের পর ২০০৯ সালের ১৫ জুলাই আলমগীরের পক্ষে দেওয়া রায় বাতিল করে নির্বাচন কমিশন ও রিটার্নিং কর্মকর্তার দেয়া রায় বহাল রাখেন চেম্বার জজ। ফলে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হয়ে যায়। ২০১০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পদ বাতিল করে গেজেটও প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন।

এরপর ২০১১ সালের ৫ জানুয়ারি গেজেট প্রকাশের ওপর ৬ মাসের স্থগিতাদেশ দেয় উচ্চ আদালত। পরে নবম সংসদের পূর্ণ মেয়াদই সংসদ সদস্য পদে বহাল থাকেন মহীউদ্দিন খান আলমগীর।

সাজা বাতিলের আদেশ বাতিলেও মায়ার মন্ত্রিত্ব বৈধ

জরুরি অবস্থা চলাকালে ২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত আওয়ামী লীগেরই আরেক নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়।

পরে মায়া ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যান। তার আপিলের শুনানি করে ২০১০ সালের ২৭ অক্টোবর বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের হাই কোর্ট বেঞ্চ তাকে খালাস দেয়।

আর ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য হওয়ার পর মায়া দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান মায়া।

তবে ২০১৫ সালের ১৪ জুন সে সময়ের প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাসহ তিন সদস্যের আপিল বেঞ্চ মায়াকে খালাস দিয়ে দেয়া আদেশ বাতিল করে আবার শুনানির নির্দেশ দেয়।

এরপর মায়ার সংসদ সদস্য পদ এবং মন্ত্রিত্বের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৭ জুলাই রিট আবেদনটি করেন আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। কিন্তু পরে একই বছরের ১৯ নভেম্বর সে রিট খারিজ করে দেয় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। এখনও মায়া মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য হিসেবে বহাল আছেন। যদিও সেই মামলাটি এখনও শেষ হয়নি।

তবে মায়ার মামলাটির শুনানি এখনও হাইকোর্টে শুরু হয়নি। অর্থাৎ এখনও তিনি নির্দোষ-এই কথা বলার সুযোগ নেই।
খবর৭১/জি;

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here