মোঃ জহিরুল ইসলাম মৃৃধা,সোনারগাঁও (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধিঃ আধুনিকতার ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে এক সময়কার অতি প্রয়োজনীয় কামার শিল্প। তবে প্রতি বছর পবিত্র ঈদুল আযহার সময় কদর বেড়ে যায় এ শিল্পের। তখন শিল্পীরা অতিবাহিত করেন বছরের ব্যস্ততম সময়। এ সময় টুং টাং শব্দে মুখর হয়ে হয়ে উঠে সোনারগাঁয়ের কামার পল্লীগুলো।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, স্থানীয় পেশাদারি কামার পল্লী মোগরাপাড়া চৌরাস্তা, কাইকারটেক, লাঙ্গলবন্দ বাজার, কাঁচপুর, নয়াপুর, দড়িকান্দি, মেঘনা, মঙ্গলেরগাঁও, বারদী, আনন্দবাজারসহ উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে কামার পল্লীগুলোতে ব্যাপক উৎসাহের সঙ্গে দা, বটি, চাকু, ছুরা, কুড়াল, চাপাতিসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরি করছে কামাররা। এসব ব্যবহার্য জিনিস স্থানীয় চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি দেশের বিভিন্নস্থান থেকে আসা পাইকারি ব্যবসায়ীরা নিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় বাজার থেকে লোহা কিনে সেগুলো আগুনে পুড়িয়ে দা, বটি, চাকু, ছুরা, কুড়াল, চাপাতিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরি করছে কামার শিল্পীরা। বর্তমান আধুনিক যন্ত্রাংশের প্রভাবে কামার শিল্পের দুর্দিন চললেও পবিত্র ঈদুল আযাহাকে সামনে রেখে জমে উঠেছে এ কামার পল্লীগুলো । এ সময় কাজের ফাঁকে শিল্পীরা জানান, মুসলমানদের পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষে সম্প্রতি উপজেলার প্রত্যেকটি পশুর হাটের পাশে স্থায়ী ও অস্থায়ী দোকানগুলোতে প্রচুর পরিমান ছুরি, চাপাতি, দা, বটি, ছেনিসহ কুরবানীর কাজে ব্যবহৃত সকল উপকরণ বিক্রি হচ্ছে।
উপজেলার বারদী ইউনিয়ানের কামার শিল্পী অমর জানান, এ শিল্পের প্রধান উপকরণ লোহা ও ইস্পাত এবং কর্মকারদের ব্যবহৃত হাতুড়ি, সাঁড়াশিসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতির দর আগের তুলোনায় বহুগুন বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে দিন দিন উন্নত প্রযুক্তির স্টীলের দা, ছুরি, কুড়ালসহ অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় উপকরণ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে লোহার ছুরি, চাপাতি, দা, বটি, খন্তা, কুড়াল, কোদাল ও নিড়ানীর কদর এখন আর আগের মত নেই। তাই রুজি-রোজগার কমে যাওয়ায় দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করেও পরিবার-পরিজন নিয়ে দু’বেলা পেট পুরে খেতে কষ্ট হচ্ছে। অর্থাভাবে শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ সর্বক্ষেত্রেই হচ্ছি ভোগান্তির শিকার। তবুও বাপ-দাদার পেশা, তাই এটা ধরে রেখেই সংসার চালানোর চেষ্টা করছি।
বাসু কর্মকার আরো বলেন, বাপ, দাদার কালের এই পেশা আমি শিখেছি লেখাপড়া জানা নেই। সেই জন্য অন্য কোন কাজে যেতে পারিনা। সারা বছরই সংসার অভাবে চলে। তবে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা এই কাজ করে আসছে আমিও এই কাজেই আছি অন্য কোন কাজ জানা নেই। সেই জন্য সারাবছর তেমন কোন কাজ না থাকলেও কোরবানির সময় আমাদের কাজের চাহিদা অনেক গুন বেড়ে যায়। এসময় আমার স্ত্রী রানীবালা আমাকে এই কাজে সাহায্য করে। দুজন মিলে কাজ করলে কোরবানির ঈদের সময়টুকুতে সংসার নিয়ে একটু ভাল থাকি।
এব্যাপারে বিভিন্ন হাটের কামার শিল্পীরা বলেন, এই পেশায় আমরা যারা আছি তারা খুবই অবহেলিত। বর্তমান বাজার মূল্যের যে উর্ধগতি সব জিনিসের দাম বেশি হওয়াতে সে অনুযায়ী আমরা আমাদের কাজের ন্যায্য মূল্য পাইনা। এই পেশায় থেকে সংসার চালাতে খুবই কষ্ট হয়। কামার শিল্পীরা মনে করেন সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও কোন আর্থিক সহযোগিতা না পেলে হয়তো এ শিল্প অচিরেই একদিন হারিয়ে যাবে।
মোগরাপাড়া চৌরাস্তা বাজারের কামার শিল্পী তপন কর্মকার জানান, একসময় লোহা আগুনে পুড়িয়ে দা, বটি, কোদাল, খন্তা, সাবল, টেটা, কাচি, চাকু, ছুরা, কুড়াল, চাপাতিসহ কৃষি উপকরনের বিভিন্ন জিনিসপত্র তৈরিতে কামারদের যথেষ্ট চাহিদা ও কদর ছিল বর্তমানে তা আর নেই। মেশিনের সাহায্যে বর্তমানে আধুনিক যন্ত্রপাতি তৈরি হচ্ছে। যার ফলে কামারদের তৈরি যন্ত্রপাতির প্রতি মানুষ দিনদিন আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে, হয়তো বা একসময় এই পেশা আর থাকবেনা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তবে কোরবানির ঈদের সময় আমরা একটু আশাবাদী হই। সারা বছরের তুলনায় কোরবানির ঈদের সময় রোজী রোজগার অনেক বেশি হয়।
অনিল কর্মকার আরো বলেন, বাপ, দাদার কালের এই পেশা আমি শিখেছি লেখাপড়া জানা নেই। সেই জন্য অন্য কোন কাজে যেতে পারিনা। সারা বছরই সংসার অভাবে চলে। তবে আমাদের পূর্ব পুরুষেরা এই কাজ করে আসছে আমিও এই কাজেই আছি অন্য কোন কাজ জানা নেই। সেই জন্য সারাবছর তেমন কোন কাজ না থাকলেও কোরবানির সময় আমাদের কাজের চাহিদা অনেক গুন বেড়ে যায়। তাছারা দুইবছর দরে এ কর্ম ভাল চলছেনা। তাই সারা বছর দু’বেলা পেট পুড়ে খাওয়ার জন্য অধিকাংশ কর্মকার ধীরে ধীরে বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন।
এব্যাপারে বিভিন্ন হাটের কামার শিল্পীরা বলেন, এই পেশায় আমরা যারা আছি তারা খুবই অবহেলিত। বর্তমান বাজার মূল্যের যে উর্ধগতি সব জিনিসের দাম বেশি হওয়াতে সে অনুযায়ী আমরা আমাদের কাজের ন্যায্য মূল্য পাইনা। এই পেশায় থেকে সংসার চালাতে খুবই কষ্ট হয়। কামার শিল্পীরা মনে করেন সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা ও কোন আর্থিক সহযোগিতা না পেলে হয়তো এ শিল্প অচিরেই একদিন হারিয়ে যাবে।
খবর ৭১/এসঃ