জয়পুরহাটে তিন’শতাধিক কিডনি বিক্রেতারা এখন মৃত্যুর প্রহর গুণছে!

0
310

মোঃ অালী হাসান জয়পুরহাট জেলা প্রতিনিধিঃ জয়পুরহাটের কালাইয়ে ঋণের দায়ে জর্জরিত প্রত্যন্ত গ্রামীন জনপদের সহজ-সরল, অশিক্ষিত, অভাবী ও খেটে
খাওয়া শত শত মানুষেরা এক সময় কিডনি ক্রেতা দালালদের চটকদার কথায় খপ্পরে পড়ে ভুল করে গোপনে তাদের কম মুল্যে শরীরের মহা মূল্যবান অঙ্গ কিডনি বিক্রি করে আজ তারা নিজের কৃতকর্মের জন্য নিজের কাছেই অনুতপ্ত হচ্ছেন। বর্তমানে তারা আছেন মারাক্তক ভাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। কেউবা গুণছেন এখন মৃত্যুর প্রহর। আর যারা আবার ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছেন তারা কর্মহীনতাসহ অসহায়ত্ব ও সমাজে প্রতিনিয়ত হেয় প্রতিপন্নতা হচ্ছে। তারা কোন উপার্জন মূলক কাজ করতে
না পারায় তাদের গোটা পরিবার এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তবে এরপরও, প্রতিনিয়ত নতুন ভাবে এলাকার বিভিন্ন দালালদের চটকদার কথায় খপ্পরে পড়ে অভিনব কৌশলে ফের ওইসব গ্রামের অনেক মানুষেরা গোপনে কিডনি বিক্রি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় গিয়ে কিডনি বিক্রির বিষয়ে
সেখানকার ভয়াবহ চিত্র সামনে ফুটে উঠেছে, গত কয়েক বছর থেকে উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নের মোসলিমগঞ্জ, বহুতি, শিমরাইল, জয়পুরবহুতি, নওয়ানা, টাকাহুত,
নওয়ানাবহুতি, দুর্গাপুর, বহুতিগুচ্ছগ্রাম, উত্তরতেলিহার, ফুলপুকুরিয়া, তেলিহার, ভুষা, কাশীপুর, পাইকপাড়া, বিনইল ও পূর্বকৃষ্টপুর। আহম্মেদাবাদ ইউনিয়নের রাঘবপুর, বৈরাগীপাড়া ও বোড়াই এবং মাত্রাই ইউনিয়নের অনিহার, পাইকশ্বর, ভেরেন্ডি, উলিপুর, সাতার, কুসুমসাড়া ও ইন্দাহার গ্রামের সহজ-সরল, অশিক্ষিত,
অভাবী ও খেটে খাওয়া শতশত মানুষেরা বিভিন্ন এনজিও এবং স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে,
সেই ঋণের দায়ে জর্জরিত হওয়া উপজেলার প্রায় ২৭টি গ্রামের ওইসব মানুষেরা এলাকার কিডনি ক্রেতা দালালদের খপ্পরে পড়ে, ভুল করে গোপনে তাদের কিডনি বিক্রি করেন এবং কিডনি বিক্রির পরে মুল টাকা না পেয়ে প্রতারণার শিকার হয়ে আজ তারা নিজের কৃতকর্মের জন্য নিজের কাছেই অনুতপ্ত। তারা কিডনি
ক্রেতার সাথে জড়িত বিভিন্ন দালালদের লোভনীয় অফারে, মোটা অংকের আর্থিক লোভে, কিছুটা আরাম- আয়েশী জীবন যাপনের আশায় এবং সংসারের স্বচ্ছলতার স্বপ্ন দেখে এক সময় তারা শরীরের মহা
মূল্যবান অঙ্গ কিডনি বিক্রি করলেও এখন অর্থের অভাবে হচ্ছেনা তাদের চিকিৎসা এবং ঔষধ। তাছাড়া সরকারী-বেসরকারী ভাবে পাচ্ছে-না স্বাস্থ্য সেবাসহ ঔষধ-পত্র
ও সুপরামর্শ। অন্যদিকে, তাদের দিন দিন স্বাস্থ্যের উন্নতির চেয়ে বরং অবনতি হচ্ছে। তাদের বাড়ছে শারীরিক ভাবে বিভিন্ন সমস্যা। ফলে তারা দিনেদিনে হারিয়ে ফেলছেন কর্মক্ষমতা। আর পরিবারের মধ্যে উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের কর্মক্ষমতা না থাকায় ক্রমাগত অর্থনৈতিক কর্মকা-ে থেকে দূরে সরে যাবার কারণে ওই
সব শতশত পরিবারগুলো এখন অসহায়ত্বের দিকে ধাবিত হচ্ছেন। ফলে কিডনি বিক্রেতারা কোন উপার্জন মূলক
কাজ করতে না পারায় তাদের গোটা পরিবার বর্তমান মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কালাই উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নের শিমরাইল গ্রামের কিডনি বিক্রেতা মৃত আমেজ হোসেনের ছেলে
মো.আবেদ রহমান (৩৮) বলেন, অভাবের কারনে বিভিন্ন এনজিও এবং স্থানীয় দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঋণের বোঝায় কাঁধে নিয়ে এবং অর্থের
লোভে পড়ে মাত্র ১লাখ ৬০হাজার টাকার বিনিময়ে গত ৩ বছর আগে কিডনি বিক্রি করেছি। সেই সঙ্গে নিজের কর্মক্ষমতাকেও বিক্রি করেছি। এখন আমি আর কোন
কাজকর্ম করতে পারি না। এখন নিজেকে বড় অসহায় আর অপরাধী মনে হয়। লজ্জায়ে লোকালয়ে ভালোভাবে চলাফিরা করতে মনে চায়না। সমাজে কিডনি বিক্রি
করা মানুষ হিসেবে প্রতিনিয়ত হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছি। তাছাড়াও বর্তমান শারীরিক ভাবে ভালো নেই। কোন কাজ করতে পারছিনা। বর্তমান অর্থিক ভাবে অনেক অভাবের মাঝে আছি। মনে হচ্ছে,বেঁচে থাকার চেয়ে
এখন আমার মৃত্যু অনেক ভালো। আমি যে ভুল করেছি, এমন ভুল যেন আর কেউ না করে। কালাই উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়নের তেলিহার গ্রামের কিডনি বিক্রেতা আব্দুল জলিলের স্ত্রী মুক্তি বেগম
(২৮) বলেন, বর্তমানে আমি ভালো নেই। টাকার অভাবে ভালো খেতে ও চিকিৎসা করতে পারছিনা। আমার অভাবী সংসার। সংসারের জন্য ভারী কোন কাজ করলে
সারা শরীলে প্রচন্ড ব্যথা হয়। মুখ-চোখ ও হাত-পা প্রায় সময়ে ফুলে থাকে। একটু হাঁটাচলা করলেই শাসকষ্ট দেখা দেয়। অনেক সময়ে গায়ে জ্বর থাকে, প্রসাবে জ্বালা-যন্ত্রণাও হয়। সব কিছু মিলে মনে হয়-এই বুঝি আমার মরণ হলো। কালাই উপজেলার মাত্রাই ইউনিয়নের ভেরেন্ডি
গ্রামের কিডনি বিক্রেতা নুরুল ইসলামের ছেলে আকতার আলম (৩৫) বলেন, গত ২০০৯ সালে এলাকার কিডনি ক্রেতা তারেক দালালের খপ্পরে পড়ে শরীরের মহা
মুল্যবান অঙ্গ কিডনি বিক্রি করেছি। মাত্র ৪ লাখ টাকায় কিডনির দর দাম ঠিকঠাক হলেও প্রতারণার শিকার হয়ে মাত্র ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা পেয়েছি। ওই টাকা দিয়ে ৫টি এনজিওর ঋণের আসল টাকা পরিশোধ করেছি। বর্তমান আমি এক এনজিওর ৩০ হাজার টাকার কিস্তির বোঝা টানছি। জীবনের ভুল কাজের অনুশোচনা করে তিনি আরও বলেন, আগে মানুষের বাড়িতে কাজ করে বা কখনো ভ্যান চালিয়ে দিনে প্রায় ২শ টাকা পেলেও আমার সংসার ভালো চলত এবং
শারীরিকভাবেও সুস্থ ছিলাম। আর এখন দিনে প্রায় ৪শ টাকার আয় করেও সংসার ভালোভাবে চলছেনা। প্রতি মাসে আমাকে অনেক টাকার ঔষধ কিনতে হচ্ছে।
সংসারে আয়ের চেয়ে এখন ঔষধের পিছনে খরচ বেশী হচ্ছে। কালাই উপজেলার আহম্মেদাবাদ ইউনিয়নের বোড়াই গ্রামের কিডনি বিক্রেতা বেলাল হোসেনের স্ত্রী জোসনা বেগম (৩০) বলেন, কিডনি বিক্রির বিষয়ে অনেক জানা-জানি হলে সেই সময় কিডনি বিক্রেতাদের বিভিন্ন সহায়তার জন্যে এগিয়ে আসেন সরকারি ও বেসরকারিসহ বিভিন্ন সংস্থা। উপজেলার বৈরাগীহাটে কয়েক দিনের জন্য বসেছিল চিকিৎসা ক্যাম্পসহ বিভিন্ন
ক্যাম্প। সেখানে বড় বড় সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তারাও এসেছিল। আমাদেরকে দিয়েছিল চিকিৎসা সেবা ও সুপরামর্শ। এখন আর আমাদেরকে কেউ
খোঁজ খবর রাখেনা। কালাই উপজেলার উদয়পুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান
মো.ওয়াজেদ আলী দাদা এবং আহম্মেদাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলী আকবর বলেন, গত কয়েক বছর থেকে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের মানুষেরা গোপনে তিন’শতাধিক কিডনি বিক্রি করেছেন। তবে এদের
অধিকাংশের অবস্থাই বর্তমান খুব করুণ। তারা আরও বলেন, শুনেছি এর পরেও না-কি আবার নতুন ভাবে,অভিনব কৌশলে ফের ওইসব গ্রামের আশপাশের অনেক মানুষেরা এখনও গোপনে কিডনি বিক্রি করছেন। কালাই থানা অফিসার ইনচার্জ মো.আব্দুল লতিফ খান বলেন, বর্তমান উপজেলাতে নতুন করে কেউ কিডনি
বিক্রি করেনি। তাছাড়া কিডনি বিক্রি রোধে আমরা প্রত্যন্ত এলাকাতে গণসচেতনামূলক বিভিন্ন কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছি। কালাই উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা
কর্মকর্তা ডা.মনজুর আহমেদ বলেন, যারা অর্থের জন্য কিডনি বিক্রি করেছেন। তারা জীবনে বড় ধরনের ভুল করেছেন। কারন, কিডনি দান করার পুর্বে কিডনি দাতার
শারীরিকভাবে বিভিন্ন স্থরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়, তিনি কিডনি দানের সক্ষম কি না তা ভালোভাবে বোঝার জন্য। কিন্তু কিডনি বিক্রির ক্ষেত্রে সেগুলো
তেমন পরীক্ষা করা হয় না বিধায় শারীরিক ভাবে অনুপযুক্ত অনেক মানুষের কাছ থেকে কিডনি সংগ্রহ করা হয়। সেই সকল অনুপযুক্ত মানুষেরা পরবর্তী কালে জীবনে
বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যসমস্যায় ভুগে থাকেন। এমনকি তারা মৃত্যুর মুখেও পতিত হয়। তবে, এলাকার কিডনি বিক্রিতারা যদি আমাদের কাছে চিকিৎসা সেবা নিতে
আসেন তারা অবশ্যই সঠিক ভাবেই চিকিৎসা সেবাই পাবেন। কালাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মো.আফাজ উদ্দিন বলেন,নতুন করে কিডনি বিক্রির প্রমানিত হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাছাড়া ইতোপুর্বে
গোপনে ও লোভে পড়ে যারা শরীরের মূল্যবান অঙ্গ কিডনি বিক্রি করছেন। ওইসব কিডনি বিক্রিকারীদের মধ্যে যাচায়-বাচায় করে বেশী অসুস্থতাদের
প্রয়োজনীয়তা সহায়তা দেয়া হবে।

খবর ৭১/ই:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here