ছোট্ট একটা আশা!

0
986
মিস্টার বিড়ালের বাংলাদেশ এবং অনুচ্চারিত খবিশ ও রাবিশ
ডাঃ মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল, চেয়ারম্যান, লিভার বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও অর্থ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।

খবর৭১ঃ মাঝে মাঝে ভুলে যাই আমি কি? আমি কি শিক্ষক, চিকিৎসক না অন্য কিছু। ডাক্তারি আর শিক্ষকতার ফাঁকে-ফাঁকে নয়, বরং পাশাপাশি এটা-সেটা করে বেড়াতে গিয়ে আমার যে নানামুখী দৌড়-ঝাঁপ, সেই তালিকায় একটা উল্লেখযোগ্য জায়গা জুড়ে আছে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে যোগ দেয়া আর মাঝে-সাঝে বক্তব্য দেয়া। আমার এসব বক্তব্য শুনে কার কি লাভ হয় জানি না, তবে আমার লাভ হয় ভালই। একদিকে চিন্তার খোরাক জোটে আর অন্যদিকে পরের সভায় বলার জন্য মাল-মসলারও বেশ জোগাড়-যন্তর হয়। এমনি এক সভায় সেদিন বেশ ভারি আলোচনা হচ্ছিল ‘পলিটিক্যাল স্পেস’ নিয়ে। শব্দটা আমার কাছে নতুন। মন দিয়ে শুনি, বোঝার চেষ্টা করি। শুনলাম আর বুঝলামও ভালই। কারণ যারা বলছিলেন তারা আমাদের সুশীল সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সভ্য।

‘পলিটিক্যাল স্পেস’ তো আসলেই দরকার। এটা তো অস্বীকার করার কোনই উপায় নেই যে, আজকের বিএনপির রাজনীতি নয়াপল্টন আর প্রেসক্লাবে বন্দী। একদিন যে দলটি ছিল দোর্দ- প্রতাপে ক্ষমতায় আর কিছুদিন আগেও ছিল সদ্য সাবেক বিরোধী দল। ইদানীং তাদের পরিচিতি বিরোধী দল (অবসরপ্রাপ্ত), আর সামনে হয়তবা মুসলিম লীগের মতো পরিণতি! আর জামায়াত? অন্ধকার আর নেপথ্যের খেলায় তারা যতই সচল থাকুক, যতই মজবুত হোক ভার্চুয়াল জগতে তাদের ভিত্তি, সাংগঠনিকভাবে জামায়াতকে খুঁজতে গেলে মাইক্রোস্কোপেও খুঁজে পাওয়া কঠিন আজকের বাংলাদেশে। অতএব, আওয়ামী লীগের চাপে চিড়ে-চ্যাপ্টা বিএনপি-জামায়াতের জন্য ‘পলিটিক্যাল স্পেস’-এর প্রয়োজনীয়তাতো অনস্বীকার্য। কিন্তু বাস্তবে কি তারা এই দাবিটা করতে পারে? সেই মুখ কি তাদের আছে? এই ক’দিন আগেও ২০১৩-১৪-তে যারা নির্বিচারে পুড়িয়ে মেরেছে মানুষ থেকে গরু সবকিছু, যাদের আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে বাড়ি-গাড়ি, স্কুল-পাঠাগার-রেলপথ, তাদের মুখে ‘পলিটিক্যাল স্পেস’-তো দূরে থাক, পলিটিক্স শব্দটাই কি খুব বেমানান নয়? ক’দিন আগে গিয়েছিলাম মিরপুরে ‘শহীদ স্মৃতি পাঠাগার’-এর ২৫ বছর পুর্তির অনুষ্ঠানে। নির্মূল কমিটির পৃষ্ঠপোষকতায় সারাদেশে স্থাপিত হয়েছিল এমনি অর্ধ-শতাধিক পাঠাগার। লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রচার আর প্রসার। ২৫ বছর পর টিকে আছে শুধুই মিরপুরের পাঠাগারটি। আর সবগুলো ভস্মীভূত হয়েছে ২০১৩-তে বিএনপির ‘গণতান্ত্রিক’ তা-বে। আর সবকিছু বাদ দিন, শুধু এই একটি অপরাধেই কি বাংলাদেশে বিএনপির রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়া উচিত নয়? আর ‘৭১-এর ন্যক্কারজনক ভূমিকার জন্য জামাতের যে কতবার নিষিদ্ধ হওয়া উচিত, সে প্রসঙ্গ না হয় না-ই টেনে আনলাম।

ভারতের স্বাধীনতার পর প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত নেহেরু বিরোধী দলের নেতাকে ডেকে বলেছিলেন একটা দায়িত্বশীল বিরোধী দল গঠন করতে। বলেছিলেন কংগ্রেস এবং তিনি এজন্য সাহায্য করবেন। এখানেই নেহেরুর পান্ডিত্য। অরাজনৈতিক আর প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি যখন বিরোধী দলে থাকে, তখন রাজনীতি আর রাজনৈতিক দলের যে কি পরিণতি হয়, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ আজকের বিএনপি-জামায়াত। আর অপরিপক্ক বিরোধী রাজনৈতিক দল যখন ‘পলিটিক্যাল স্পেস’ পায় তখন বোধহয় তাদের জাতীয় পার্টি বলা হয়। আজকে আমরা অনেক ধাক্কা খেয়ে হাড়ে-হাড়ে প-িত নেহেরুর দূরদর্শিতা টের পাচ্ছি। তবে এই বিষয়টা নিজ প্রজ্ঞায় বুঝেছিলেন এদেশেরই একজন রাষ্ট্রনায়ক আজ থেকে প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে। একটু পরে আসছি সেই প্রসঙ্গে।

আমাদের আজকের রাজনীতিতে ‘পলিটিক্যাল স্পেস’-এর গুরুত্বটা বোধহয় বেশি। আজ যারা ‘পলিটিক্যাল স্পেস’-এর দাবিতে সোচ্চার, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, তারা হয় দেশদ্রোহী নয়তো দেশ বিরোধী। কাজেই তারা আর যাই হোক ‘পলিটিক্যাল স্পেস’-এর দাবিদার হতে পারে না। অন্যদিকে এই শূন্যতার সুযোগে যারা আজকে ‘পলিটিক্যাল স্পেস’ ভোগ করছে, তারা সেই সুযোগের সদ্ব্যবহারের যোগ্যতা রাখে না। তাদের সে যোগ্যতা থাকলে বিরোধী দলের সাংগঠনিক ও সংসদীয় নেতা ঠিক করে দেয়ায় অন্তত আর যাই হোক মাননীয় সংসদ নেত্রীর হস্তক্ষেপের প্রয়োজন পড়ত না।

এই ডামাডোলে দেশের পুরো ‘পলিটিক্যাল স্পেস’টাই এখন আওয়ামী লীগের করায়ত্তে। পুরো দেশটাই এখন আওয়ামী লীগময়। হিসাবে সেটা ভাল হবারই কথা। কারণ বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসে এই দলটাইতো বাঙালী জাতিকে প্রথমবারের মতো উপহার দিয়েছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আর একজন স্বাধীন বাঙালী শাসক। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই যে, বর্তমান বাস্তবতাটা ঠিক সেরকম নয়। সময়-সময়েই দুর্বিনীত হয়ে উঠছে আওয়ামী লীগ, হয়ে উঠছে আত্মবিধ্বংসী। মাঝে মাঝেই তাই আমরা দেখছি আবরার কিংবা ক্যাসিনো জাতীয় শিরোনাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেও একাধিক সংবাদ সম্মেলনে দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের কারও কারও মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রবণতার প্রসঙ্গটি টেনে এনেছেন। তিনি ঘোষণা দিয়ে ঘর থেকে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন আর ঘোষণা দিয়েছেন তা অব্যাহত রাখার। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা কি স্থায়ী সমাধান হতে পারে?

আজকের বাস্তবতা এই যে, আওয়ামী লীগকে যেমন শুদ্ধ হতে হবে, তেমনি বিরোধী দলকেও শিখতে হবে কিভাবে যথার্থ বিরোধী দল হয়ে উঠতে হয়। প্রক্রিয়াটির সূচনা আমরা দেখছি এবং অবশ্যই সামনে থেকে যথারীতি সেই মহাযজ্ঞে নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। এতে তিনি সফল হবেন সন্দেহ নেই। সন্দেহ থাকছে এর সুফল কতদিন স্থায়ী হবে, তা নিয়ে। কারণ এই পরিবর্তিত ‘পলিটিক্যাল স্পেস’-কে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে পুরো প্রক্রিয়াটিকে একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আনতে হবে। প্রয়োজনে যেমন নির্মমভাবে উপড়ে ফেলতে হবে আওয়ামী লীগের উচ্ছিষ্টদের, তেমনি স্পেস করে দিতে হবে আওয়ামী লীগের বাইরে থাকা প্রতিটি সৎ, যোগ্য, অসাম্প্রদায়িক আর স্বাধীনতার সপক্ষের মানুষকে। শুধু রাজনীতিতে নয়, তাদের জন্য স্পেস ছেড়ে দিতে হবে নীতি নির্ধারণী জায়গাগুলোয়, জাতীয় সংসদেও। দুর্বিনীত অশুভ শক্তির দাপটে রাজনীতিতে সুশীল সাংসদ নির্বাচন করাটা অনেক সময়ই কঠিন। প্রয়োজনে সেই দায়িত্ব নিতে পারে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রই পারে প্রয়োজনে প্রার্থীকে জনতার সামনে তুলে ধরতে। বঙ্গবন্ধুর সময়ে আমরা একাধিক ক্ষেত্রে এই ধরনের ব্যবস্থাপনার সুফল দেখেছি।

শতধা বিভক্ত শুভ শক্তিগুলোকে এককেন্দ্রিক শুভবলয়ে নিয়ে আসার প্রয়োজনীয়তাটা আজ থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে যে প্রজ্ঞাবান নেতা অনুধাবন করেছিলেন, তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বুঝেছিলেন বলেই প্রয়াত মনি সিং-কে ‘সাইনবোর্ডটা’ বদলের কথা বলেছিলেন। প্রজ্ঞাবান মণি সিং-ও সানন্দে সম্মতি দিয়েছিলেন সেই আহ্বানে। আর আমাদের পূর্বসূরিরা, আর তারপর আমরাও সেই প্রজ্ঞাকে কতভাবেই না বিতর্কিত করেছি। বলেছি একদলীয় শাসন, গণতন্ত্রের হত্যা, আরও কত কি! বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে অগণতান্ত্রিক শক্তির হাতে জাতির জনক হত্যার চেয়ে শুভশক্তিগুলোর এককেন্দ্রিকতায় যে বিপুল শক্তি, তা আমরা সেদিন আত্মস্থ করতে পারিনি। সামনে এ সুযোগ আর আসবে কিনা, জানি না। যদি আসে আমরা যেন মননে আর মানসিকতায় প্রস্তুত থাকি তাকে সাগ্রহে বরণ করতে। এতটুকুই আপাতত প্রত্যাশা। বাকিটুকু ভবিষ্যতই বলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here