চৌগাছায় কপোতাক্ষ নদ অবৈধ দখলের কবলে পড়ে মরা খালে পরিনত হয়েছে

0
272

খবর৭১:মুকুরুল ইসলাম মিন্টু চৌগাছা (যশোর) ॥ যশোরের চৌগাছার উপর দিয়ে বয়ে চলা মহাকবি মাইকেল মধুসুধন দত্তের কপোতাক্ষ নদ এখন মরা খালে পরিনত হয়েছে। অবৈধ দখল, দুষন আর পলি জমে ভরাট হওয়ার করনে নদটি মরার আগেই মরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। শুস্ক মৌসুমের আগেই নদ পানি শুন্য হয়ে পড়েছে। এক শ্রেনীর অসাধু ব্যক্তি কপোতাক্ষকে তাদের ইচ্ছামত ব্যবহার করে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে বলে অভিযোগ। নদের মাঝে পাটাতন দিয়ে মাছ চাষ করা, নদের জায়গা দখল করে বসতবাড়ি নির্মান করা, পুকুর তৈরী করাসহ নানা ভাবে দখল নিয়েছে একটি কুচক্রি মহল। অনেকে নদের জমিতে বসতবাড়ি তৈরী করে ওই বাড়ি থেকে রীতিমত আয় রোজগারে নেমে পড়েছেন। বলাচলে কপোতাক্ষকে অঘোষিত ভাবে দখলের প্রতিযোগীতায় নেমেছে একটি অসাধু মহল। দখল আর দূষনের কবল থেকে কপোতাক্ষকে বাঁচানোর এখনই সময়। অন্যথায় অচিরেই স্মৃতির পাতা থেকে হারিয়ে যাবে কপোতাক্ষের ঐতিহ্য মনে করছেন উপজেলার সচেতন মহল।
সূত্র জানায়, যশোরের চৌগাছা সীমান্তবর্তী একটি উপজেলা। ১১ টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত এ উপজেলাকে কপোতক্ষ নদ বলা চলে দু’ভাগে বিভাক্ত করে রেখেছে। সুদুর চুয়াডাঙ্গা জেলার মাথাভাঙ্গা থেকে উৎপত্তি কপোতাক্ষ নদের। প্রায় ৬৫ মাইল দুরাত্ব এই নদ সাপের মত আঁকা বাঁকা হয়ে চৌগাছার বুক চিরে মিলিত হয়েছে দক্ষিনে বঙ্গোপসাগরে। বৃটিশ শাসনামলে কপোতক্ষ নদে চলেছে বিশাল বিশাল পন্যবাহি জাহাজ। বৃটিশ বণিকেরা এ সময় জাহাজে করে বর্তমান উপজেলার পাশাপোল ইউনিয়নের খলশী বাজর নামক স্থানে এসে তাদের বহনকরা জাহাজ নোঙ্গর করত। বৃটিশরা ওই জাহাজে করে বয়ে আনত চুন, লবণ, কেরোসিন তেল, পোশাক, শিশুদের খেলনা ইত্যাদি। খালাশীরা (মুটে) জাহাজ থেকে এখানে মালামাল খালাশ করায় এই স্থানকে সে সময় খালাশি বলে ডাকা হতো। খালাসি থেকে পরবর্তীতে স্থানটি খলশি নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এই ভুখন্ডে বৃটিশরা প্রয়োজনীয় কাজ সম্পন্ন করে এখান থেকে নীল, চিনি, গুড়সহ নানা পন্য ওই জাহাজে বোঝাই করে কপোতাক্ষ দিয়ে পাড়ি জমাত নিজ দেশে।
এলাকাবাসিরা জানান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরও এই কপোতাক্ষ নদে নিয়মিত জোয়ার ভাটা আসত। পাল তোলা নৌকা নিয়ে মাঝি মনের সুখে গান গাইতে গাইতে নিজ গন্তব্যে পৌছাতেন। ভরা যৌবনের কপোতাক্ষের অঢেল পানি আর জীব বৈচিত্র এক অপরুপ সৌন্দর্য বিরাজ করত গোটা কপোতাক্ষ পাড় জুড়ে। সে সময়ে কপোতাক্ষ নদে দেশী প্রজাতির মাছের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের মাছের ব্যাপক সমারোহ ছিল। এই নদকে আয়ের কেন্দ্রস্থল তৈরী করে এর পাড় দিয়ে অন্তত শতাধিক জেলে পল্লী গড়ে ওঠে। এ সব জেলেরা নদ থেকে মাছ শিকার করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করত। বছরের পুরো সময়টা জুড়ে কপোতাক্ষে থাকত অঢেল পানি। তাই সে সময়ে নদে দেখা মিলত নানা প্রজাতির পখপাখালি। কাক ডাকা ভোর হতে গভীর রাত পর্যন্ত পাখির কলরবে মুখোরিত থাকত কপোতাক্ষ। মাত্র চার দশকের ব্যবধানে সেই কপোতাক্ষ আজ মরা খালে পরিনত হয়েছে। আর এই ভয়াবহ পরিস্থিতির প্রভাব পড়েছে জীব বৈচিত্র সহ সব কিছুর উপর। সব থেকে বেশি ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছে কপোতাক্ষ পাড়ের হাজার হাজার জেলে। কপোতাক্ষে এখন আর সে ভাবে পানি থাকে না, বর্ষা মৌসুমে কিছুটা পানি দেখা গেলেও তার স্থায়িত্ব হয় দুই থেকে তিন মাস। এছাড়া বছরের বাকি নয় মাস কপোতাক্ষ শুকিয়ে ফসলি জমিতে পরিনত হয়। এ কারনে এক প্রকার বাধ্য হয়ে জেলে পল্লীর জেলেরা তাদের পেশা পরিবর্তন করে আজ অনেকে হয়েছেন দিন মজুর, কেউ নাপিত, ভ্যান চালক একটু স্বাবলম্বিরা হয়ত মুদি ব্যবসা সহ বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে।
খোজ নিয়ে জানা গেছে, অবৈধ দখল, ময়লা আবর্জনা ফেলে নদকে দূষন করাসহ নদের তলদেশে পলিজমার ফলে বছরের পুরো সময়টা কপোতাক্ষ নদে আর পানি থাকে না, তখন নদের দিকে তাকালে মনে হয় এটি গো-চরন ভূমিতে পরিনত হয়েছে। বিশেষ করে চুয়াযাঙ্গা থেকে শুরু করে যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলা পর্যন্ত কপোতাক্ষ নদ এখন মরাখালে পরিনত হয়েছে। শুস্ক মৌসুমের এই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে অবৈধ দখলদাররা কপোতাক্ষকে গ্রাস করতে মেতে উঠেছে। সম্প্রতি এক শ্রেনীর অসাধু ব্যক্তি কপোতাক্ষের জমি নিজের দখলে নিয়ে পুকুর নির্মান করেছে। আবার অনেকে এই নদের পাড়ের জমি দখলে নিয়ে তৈরী করছে বাসত বাড়ি। তারা এ সব বাসত বাড়ি আবার নিন্মবিত্তদের মাঝে ভাড়া দিয়ে প্রতিমাসে নিয়মিত ভাড়া আদায় করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ করে চৌগাছা প্রধান বাজার সংলগ্ন নদের জায়গা নানা কৌশলে দখল হয়ে যাচ্ছে। ¯্রােতহীন নদের পানিতে ফেলা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ময়লা আবর্জনা এর ফলে পানি দূষিত হয়ে নষ্ট হচ্ছে পরিবেশ। চৌগাছার সর্বত্র দাবি উঠেছে কপোতাক্ষ নদকে দখল মুক্ত করে খনন করা হলে আবার এখানে আসবে নিয়মিত জোয়ার ভাটা, চলবে পাল তোলা নৌকা। সে সময়ে কপোতাক্ষ নদ হতে পারে হাজারও মানুষের আয়ের উৎস।
খবর৭১/জি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here