চৌগাছাকে ভয়াবহ আসের্নিকে গ্রাস করেছে একটি গ্রামেই মারা গেছেন ২২ জন মানুষ

0
554

মুকুরুল ইসলাম মিন্টু চৌগাছা (যশোর)ঃ যশোরের চৌগাছা উপজেলা পানিবাহিত নীরব ঘাতক আর্সেনিকোসিস (সেঁকোবিষ) রোগ ধীরেধীরে গ্রাস করছে। এ জনপদের কিছু এলাকার মানুষ সচেতন হলেও বৃহত্তর জনগোষ্টি এখনও অসচেতন। ফলে নিরাপদ পানির বিকল্প না থাকায় বাধ্য হয়ে আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে এক প্রকার স্বেচ্ছায় মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছেন। উপজেলার সবচেয়ে ভয়াবহ আর্সেনিকযুক্ত গ্রামের নাম মাড়–য়া। এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষই বিভিন্ন মাত্রায় আর্সেনিকে আক্রান্ত। ভয়াবহ আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে এ পর্যন্ত অর্ধশত মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্ক সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে মাড়–য়া গ্রামেই মৃতের সংখ্যা প্রায় ২২ জন। আর্সেনিক রোগে তাদের মৃত্যু হয়েছে এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছে জাপানি সংস্থা জাইকাসহ বিভিন্ন সংগঠন। কিন্তু এ গ্রামে এর আগে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের মৃত্যুর কারণ শুধুই কী নানান রোগ নাকি এর পিছনে আর্সেনিক জড়িত এখনো অজানা। আর্সেনিকমুক্ত পানি পান করার জন্য পাতকুয়া, ডাগ ওয়েল, বিভিন্ন প্ল্যান্ট নির্মিত হলেও রক্ষণাবেক্ষনের অভাবে এ সবও এখন অকেজো। এ রোগের ভয়ে জীবন বাঁচানোর জন্য গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করছেন এমন পরিবারের তথ্য ও প্রমান মিলেছে।
সরজমিন মাড়–য়া গ্রাম ঘুরে আর্সেনিকের ভয়াবহতা লক্ষ্য করা গেছে। অধিকাংশ মানুষই এ রোগের শিকার। জগদীশপুর ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ইমতিয়াজ আলীর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আর্সেনিকের গ্রাম বললে সকলে মাড়–য়া গ্রামকে বোঝেন। এ গ্রামের অল্পসংখ্যক লোকজন বাদে সকলে আর্সেনিকের রোগী। আমি নিজেও এ রোগের শিকার। গ্রামের বাসিন্দা ও এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্কের সংগঠক লুৎফর রহমান (৫১) এর কাছে আর্সেনিকের ভয়াবহতা সন্মদ্ধে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এ গ্রামে আর্সেনিকে আক্রান্ত ২৫’শ থেকে ৩ হাজার রোগী রয়েছে। আমি নিজেই আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত। আর্সেনিকের কারনে আমার ফুসফুস ক্যান্সার দেখা দেয়। আমার ফুসফুসের বামপাশের অংশটি কেটে ফেলা। কোনমতে এখন বেঁচে আছি। তিনি বলেন, ২০০১ সালে এশিয়া আর্সেনিক নেটওয়ার্ক মাড়–য়া গ্রামে বিশেষ গবেষনা শুরু করেন। মাটি, পানি, মানুষের রক্ত, মলমুত্রসহ নানান বিষয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালান। তারা আর্সেনিকযুক্ত পানির উৎস্য বন্ধ করার পরিকল্পনা করেন। পরবর্তীতে নিরাপদ পানির জন্য গ্রাবেল সেন্ড ফিল্টার (জি এস এফ), পন্ড সেন্ড ফিল্টার (এ এস এফ), আর্সেনিক আয়রণ রিমুভাল প্ল্যান্ট ও ডাগ ওয়েল নির্মান করেন। ২০০৮ সালে তাদের প্রজেক্ট শেষ হয়। পানির স্তর নিচের নেমে যাবার কারনে উল্লেখিত প্ল্যান্ট থেকে মানুষ পানি সংগ্রহ করতে পারেনা। প্রজেক্ট শেষ হলেও তারা এ গ্রামকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ফলোআপে রাখেন। পরবর্তীতে মানবিক বিবেচনায় উন্নত প্রযুক্তি ও মেশিনের মাধ্যমে তারা পুরো গ্রামে নিরাপদ পানি সরবরাহে জন্য একটি বৃহৎ প্রকল্প হাতে নেন। যার সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৫ কোটি টাকা। কিন্তু ২০১৫ সালে জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও হত্যাকান্ডের শিকার হলে ওই প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি। তিনি বলেন, ৫০ শতাংশ মানুষ অতি ও মধ্যম মাত্রায় আক্রান্ত। ২৫ শতাংশ মানুষ সাধারণ মাত্রায়, আর ২৫ শতাংশ মানুষ ভালো আছেন। তিনি তথ্য নিশ্চিত করেন, এ গ্রামে ২২ জনের বেশী লোকজন আর্সেনিকে মারা গেছেন। গ্রামের বাসিন্দা রোকেয়া বেগম (৫২) জানান, আমার ডান হাতের দুটি আঙ্গুল কেটে ফেলতে হয়েছে। ২০০০ সালে ঢাকায় আমার অপারেশন হয়। আমি এখনো সুস্থ্য না। আর্সেনিকের কারনে আমাদের পরিবারে ৭ জন মৃত্যুবরণ করে। তিনি জানান, ১৯৯০ সালে প্রথম মৃত্যুবরণ করে আমার দেবর আনিছুর রহমান (২০), এরপর শ্বশুর ইয়াকুব আলী (৭০), স্বামী মুক্তিযোদ্ধা আলতাপ হোসেন (৫৫) শাশুড়ী নূরজাহান (৬৫), আব্দুল আজিজ (৫২) ইউছুপ আলী (৩৫),ইউছুপের স্ত্রী সালমা খাতুন (৩০) মৃত্যুবরণ করেন। জাপানি সংস্থা জাইকা নিশ্চিত করেন, তারা সকলে আর্সেনিকের কারনে মৃত্যুবরণ করেছেন। এছাড়া আরো একটি পরিবারে ৩ জন আর্সেনিক রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তারা হলো কাশেম আলী (৬০), তার স্ত্রী পদ্মা খাতুন (৫৩) এবং ছেলে আয়ুব হোসেন (৩৮)। এই পরিবারে মৃত্যুবরণকারী আয়ুব হোসেনের স্ত্রী জাহানারা বেগম (৩৬) বেঁচে আছেন। পরিবারের তিনজনকে হারিয়ে আর্সেনিকের ভয়ে তিনি মহেশপুরে পিতার বাড়িতে বসবাস করছেন। এছাড়া আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন আকরাম হোসেন (৪০), নূর ইসলাম (৫৫), হোসেন আলী (৫০), তার স্ত্রী ময়না বিবি (৪০), মুকতার আলী (৪৫), আতিয়ার রহমান (৪৮), আক্কাচ আলী (৪৪), মনসের আলী (৪২), ইলাহুড়ি (৬৭, ইউনুচ আলী (৫৫)। আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত মাড়–য়া বাজার মসজিদের মুয়াজ্জেন আনছার আলী (৬৫) জানান, তিনি ২০ বছর ধরে এ রোগে ভূগছেন। এখন তার শ্বাসকষ্ট আর হার্টের সমস্যা দেখা দিয়েছে। একই গ্রামের আর্সেনিক রোগী জাহানারা বেগম (৬৫), মমতাজ বেগম (৪৪), মিজানুর রহমান (৫৭), রফিউদ্দীন (৫৫), জহুরা বেগম (৪৮) সহ অনেকের সাথে কথা হয়। রোগীরা জানান, আর্সেনিক রোগ হবার পর তাদের শরীর বিবর্ণ হয়ে গেছে। কারো পা ফুলে গেছে। পায়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। শরীর দূর্বল হয়ে শক্তি-ক্ষমতা তারা হারিয়ে ফেলছেন। বিশুদ্ধ পানির উৎস সৃষ্টির লক্ষে গ্রামবাসি সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন। এ বিষয়ে উপজেলা ৫০ শয্যা হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডাঃ আওরঙ্গজেব জানান, ২/১ বছর আগেও অনেক আর্সেনিকের রোগী এসেছে চিকিৎসা নিতে। কিন্তু এখন তেমন আর আসছেনা। তিনি বলেন, নিরাপদ পানি ছাড়া আর্সেনিকের কোন ওষুধ নেই। তবে রোগীর অন্যন্য লক্ষন যেমন হাতেপায়ে ক্ষত বা ক্ষত বৃদ্ধির উপশোমের জন্য এন্টি অক্সিডেন্ট ট্যাবলেট, কমবাইন বেনজায়িন সেলিসাইলিক অয়েন্টমেন্ট দেয়া হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ সেলিনা বেগম জানান, যে সমস্ত লোক আর্সেনিক আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের তালিকা তৈরি করে আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি। প্রাথমিকভাবে এই রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসার পাশাপাশি আর্সেনিকমুক্ত পানি পান করলে রোগ ভাল হওয়া সম্ভব। তাই কষ্ট হলেও নিরাপদ ও আর্সেনিকমুক্ত পানি পান করার পরামর্শ দেন তিনি।
খবর৭১/ইঃ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here