চোরাচালানের নিরাপদ পথ কমিউটার ট্রন?

0
423

উজ্জ্বল রায়, নড়াইল প্রতিনিধিঃ এই রুট দিয়ে নিরাপদে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে যাচ্ছে ভারতীয় হেরোইন, গাঁজা, ইয়াবা, কসমেটিকস, ইমিটেশন গহনা, মসলাজাত দ্রব্য, শিশু খাদ্য, সার, কীটনাশক, বাজি, বোমা তৈরির সরঞ্জামসহ মারাত্মক অস্ত্র। চোরাকারবারী এসব পণ্য আসার প্রধান স্থানগুলো হলো বেনাপোলের দৌলতপুর, গাতিপাড়া, বড় আঁচড়া, তেরঘর, পুটখালী, সাদিপুর, গোগা, ভুলোট, কায়বা, রুদ্রপুর, ধান্যখোলা, ঘিবা, কাশিপুর সীমান্ত। চোরাচালান প্রতিহত করতে দায়িত্বে রয়েছে বিজিবি, রয়েছে পুলিশ তারপরেও চলছে অবাধে এসব ব্যবসা। আর এটাই প্রকৃত বাস্তবতা। চোরাচালানে কখনো সহায়তা করছে সীমান্তে টহলরত বিজিবির কিছু অসাধু সদস্য, কখনো কখনো নির্ধারিত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চোরাকারবারী মালামালের নিরাপত্তা স্লিপ দিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন উৎসাহিত করছে চোরাকারবারীদেরকে। জিআরপি স্টেশন মাষ্টার ও থানা পুলিশ বরাবরের মত চোরাকারবারীদের কাছ থেকে ঘুষ নেয়। উজ্জ্বল রায়,কমিউটার ট্রন থেকে নেমে জানান, বেনাপোল থেকে খুলনা পর্যন্ত দিনে একবার যাতায়াত করতো কমিউটারটি ট্রেনটি। বেনাপোল-যশোর-খুলনা রুটে চলাচলকারী কমিউটার ট্রেনটি চোরাকারবারীদের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে। আর এসব চোরাকারবারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছে ট্রেনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, জিআরপি পুলিশ ও স্টেশন মাষ্টাররা। এসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে চোরাকারবারীদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘ দিন ধরে। তবে যাত্রীদের দাবির ফলে বছর খানেক আগে একই ট্রেনটি প্রথমে সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে বেনাপোল থেকে যাত্রী নিয়ে যশোরে নামিয়ে দিয়ে বেনাপোলে ফিরে আসতো। একই ট্রেন বেনাপোল থেকে বেলা ২ টায় যাত্রী নিয়ে খুলনার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। পরে আবার যাত্রীদের সুবিধার্থে ট্রেনটি সকাল ৯টার সময়ে বেনাপোল থেকে খুলনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। একই ট্রেন আবার বেনাপোল থেকে বিকাল ৫টায় খুলনার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। তবে সেই ট্রেনটি যাত্রীদের কোন সুফল বয়ে আনতে পারেনি এখনো পর্যন্ত। পক্ষান্তরে চোরাকারবারীদের পাচারকারী বাহন হিসেবে বহুলাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ট্রেনটিতে সাধারণ যাত্রী উঠলে চোরাকারবারীদের দ্বারা বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে। ট্রেনের বাথরুম থেকে সিটের নিচে, উপরে মালামাল থাকে। এমনকি ট্রেনের সিলিং কেটেও তার মধ্যে মালামাল লুকিয়ে রাখে চোরাকারবারীরা। তবে সব দেখেও যেন না দেখার ভান করেন ট্রেনে থাকা জিআরপি পুলিশ। ট্রেনে টহলরত জিআরপি পুলিশ চোরাকারবারিদের সম্পর্ক দেখলে মনে হয় চোরাকারবারীদের পন্যগুলি অর্থের বিনিময়ে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন। এ রুটের যাত্রীরা যশোর খুলনায় যেতে বাসের চেয়ে ট্রেনের ভাড়া অনেক কম এবং আনন্দদায়ক বলে ট্রেনে যেতেই বেশি পছন্দ করে থাকেন। কিন্তু একবার যদি কোনো সাধারণ যাত্রী এ ট্রেনে উঠেন তা হলে তিনি আর দ্বিতীয় বার চোরাচালানীদের দ্বারা হেনাস্ত হওয়ার ভয়ে ট্রেনটিতে উঠতে চায় না। ট্রেনের অধিকাংশ আসনগুলো চোরাকারবারীরা দখল করে মালামাল পাচার করে থাকে। অথচ সাধারণ যাত্রীদের টিকিট কেটে ট্রেনে উঠে গাদাগাধি করে বসে থাকতে হয়। না হয় বেনাপোল থেকে খুলনা পর্যন্ত দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের গন্তব্যে পৌঁছাতে  হয়। তার উপরে চোরাকারবারীদের ধাক্কা-ধাক্কি সইতে হয়। কোন যাত্রী ভাগ্যক্রমে আসন পেলেও ট্রেন ছাড়ার পর পরই শুরু হয় চলন্ত গাড়িতে চোরাকারবারীদের মালামাল জানালা দিয়ে উঠা-নামানো। কোন যাত্রী প্রতিবাদ করলে তাকে হতে হয় চোরকারবারী দ্বারা লাঞ্ছিত। অথচ এসব চোরাকারবারীরা বেনাপোল থেকে খুলনায় ট্রেনের ৬০ টাকা ভাড়া ১০ থেকে ২০ টাকা দিয়ে যাতায়াত করে থাকে। চোরাকারবারীরা সড়ক পথে বিভিন্ন স্থানে স্থানে তল্লাশি চৌকি এড়াতেই তারা ট্রেনটিকে তাদের নিরাপদ রুট হিসাবে ব্যবহার করছে। সড়ক পথে বেনাপোল চেকপোস্ট সীমান্ত পার হলে ঢাকা-বেনাপোল সড়কের আমড়াখালি নামক স্থানে বিজিবি চেকপোস্ট, বেনাপোল বন্দর থানা, নাভারণ হাইওয়ে ফাঁড়ি, শার্শা থানা, ঝিকরগাছা থানা অতিক্রম করা খুবই ঝুঁকিপুর্ণ। অথচ ট্রেনের চোরাই পণ্য পরিবহন অনেক সহজ লভ্য ও খরচ কম। বেনাপোল স্টেশনে ট্রেনে অবৈধ পণ্য তোলাটাই শুধু সমস্যা। একবার এসব পণ্য ট্রেনে তোলা হলে বেনাপোল থেকে যশোর, খুলনা আর কোথাও বাধা নেই, নেই কোথাও বিজিবি কিম্বা পুলিশ। তাই অধিকাংশ চোরাকারবারীরা বেনাপোলের এ কমিউটার ট্রেনটিকে তাদের পাচারের নিরাপদ বাহন হিসাবে ব্যবহার করছে। ট্রেনের মধ্যে দায়িত্বে নিয়োজিত রেলওয়ে পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট হারে টাকা পেয়ে এসব চোরাকারবারী পণ্যকে বৈধ্যতা দিচ্ছে। আর নির্দিষ্ট থানা পার হতে চোরাকারবারীরা থানার দালালদের দিচ্ছে টুপলা প্রতি ১০০ টাকা করে। যখনি কোন চোরকারবারী এসব দালালদের টাকা দিতে অস্বীকার করেন তখনি দালাল ও চোরাকারবারীদের মাঝে তুলকালাম শুরু হয়। অকথ্য ভাষায় চলে চোরকারবারী মহিলাদের গালিগালাজ। যাহা যাত্রীরা শুনে মুখে কাপড় দিয়ে মুখ লুকানোর চেষ্টা করে। এভাবেই চলছে বেনাপোল থেকে খুলনাগামী কমিউটার ট্রেনের যাত্রী সেবা। ট্রেনে চলাচলকারী যাত্রীরা, আমাদের প্রতিনিধি উজ্জ্বল রায়কে জানান, বেনাপোল রেলস্টেশন এলাকায় বিজিবির টহল থাকায় সেখান থেকে চোরাকারবারীরা খুব বেশি মালামাল উঠাতে পারে না। তাই চোরাকারবারীরা অনন্ত ১০ কিলোমিটার দুরে শ্যামলাগাছী, নাভারন রেল স্টেশন ও নবীনগর এলাকায় গাড়ি থামিয়ে চোরাচালানী পন্য উঠায়। চোরাকারবারীদের সাথে ট্রেনের চালকের আঁতাত থাকায় চালক স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার পরে যেখানে মালামাল থাকে সেখানে হালকা করেন। অনেক সময় চোরাচালানীরা ট্রেনের চেইন টেনে ধরে ট্রেন থামায়। আর এসময়ের মধ্যে চোরকারবারীরা তাদের মালামাল ট্রেনের দরজা-জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে ট্রেনের মধ্যে। আর ট্রেনের মধ্যে থাকা অপর চোরাকারবারী মালামালগুলো টানা হেচড়া করতে করতে তাদের নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যায়। ট্রেন থামার স্থান গুলোর মধ্যে দিঘিরপাড়, কাগজপুকুর, ভবারবেড় পশ্চিম পাড়া, নাভারন, নাভারণ ব্রিজের উপর। তবে বর্তমানে বেনাপোল থেকে নাভারণ পর্যন্ত ট্রেনটিকে বিজিবি স্কট করার কারণে বেনাপোল থেকে মালামাল কম করে উঠায়। নাভারণ স্টেশন থেকে ট্রেনটি ছাড়ার পরে এক কিলোমিটার দুরে নাভারণ ব্রিজের কাছে গেলে ট্রেনের চেইন টেনে ট্রেনটি দাঁড় করানো হয়। এ সময়ে দ্রুত গতিতে চোরাকারবারীরা মালামাল উঠিয়ে নেয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনাপোল কমিউটারের এক ট্রেন চালক জানান, আমরা ট্রেন রাস্তায় থামাই না। চোরাকারবারীদের এক দল স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে। এর পর যেখানে যেখানে তাদের মালামাল থাকে সেখানে গিয়ে ট্রেনের হর্সপাইপ খুলে দিয়ে হাওয়া ছেড়ে দেয়। ফলে সেখানে ট্রেন দাড়িয়ে গেলে চোরকারবারীরা খুবই দ্রুত মালামাল ট্রেনে উঠিয়ে নেয়। অনেক সময়ে চোরকারবারীরা ট্রেন দাঁড়ানোর জন্য পাথরও নিক্ষেপ করেন। এ অবস্থার মধ্যে আমাদের এ রাস্তায় ট্রেন চালাতে হয়। ট্রেনের মধ্যে রেলপুলিশ কি দায়িত্বপালন করেন তা জানতে চাইলে, তিনি বলেন, ট্রেনের রেল পুলিশ বগির মধ্যে কোন চোরাকারবারী কত বস্তা মালামাল উঠেছে তার টাকা তোলা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বেনাপোল জিআরপি পুলিশের কর্মকর্তা কামাল হোসেনের কাছে ট্রেনে চোরাকারবারীদের নিকট থেকে টাকা উত্তোলনের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে আমাদের প্রতিনিধি উজ্জ্বল রায়কে জানান, বেনাপোল-খুলনা কমিউটার ট্রেন নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে। তবে চোরাচালানী বন্ধ হয়নি। তবে আপনি চেষ্টা করে দেখেন চোরাচালানী বন্ধ করা যায় কি না ? নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনাপোল স্টেশনের এক কর্মকর্তা, আমাদের প্রতিনিধি উজ্জ্বল রায়কে জানান, চোরাকারবারীদের দৌরাত্ম এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যে, স্টেশনে বিজিবি ও চোরাকারবারীরা অবৈধ্য মালামাল নিয়ে খেলার মত দৌড়াদৌড়ি করে। অনেক সময়ে চোরাকারবারীরা সরকারি অফিসের মধ্যে ঢুকে পড়ে। আমারা বাইরে থেকে এসে এখানে চাকুরী করি। তাই কাউকে কিছু বলতে পারি না। জিআরপি পুলিশ সাধারণ লোকজনকে নিরাপত্তা না দিয়ে চোরাকারবারীদের কাছ থেকে টাকা কালেকশনে ব্যস্ত থাকেন। রেলের যাত্রী নিরাপত্তা ও চোরকারবারীদের প্রতিরোধের বিষয়টি দেখার দায়িত্ব রেল পুলিশের। রেল পুলিশ এসব দায়দায়িত্ব পালন না করে বরং চোরাকারবারীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে। যে কারণে আজ সাধারণ যাত্রীরা ট্রেন ভ্রমণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। তিনি আরো জানান, রেল পুলিশের দায়িত্ব জ্ঞানহীনের কারণে অনেক সময়ে যশোরে কমিউটার ট্রেনটি পৌঁছালে বিজিবি প্রতিদিন ট্রেন না ছাড়া পর্যন্ত ডিউটি করে থাকে। এতে আমাদের চরম লজ্জায় পড়তে হয়। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা কঠোর হলে চোরকারবারীদের তৎপরতা কমবে বলে তিনি জানান।
খবর৭১/এসঃ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here