গোপালগঞ্জে ফসলি জমি ও জনবসতি এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে অর্ধ শতাধিক ইটের ভাটা

0
330

গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি : গোপালগঞ্জে ফসলি জমি ও জনবসতি এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য ইট ভাটা। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার পুখরিয়া এলাকার এ সব ইটভাটা গড়ে উঠেছে। প্রত্যেক ইট ভাটার মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে করাত কল। হুমকির মুখে কৃষি আবাদি জমি এবং জনস্বাস্থ্য ও শিশু স্বাস্থ্য নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় এলাকাবাসি।
গোপালগঞ্জের বহুল পরিচিত পুখরিয়া গ্রামে রয়েছে একটি বাজার। এছাড়াও ওই গ্রামে রয়েছে দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি কিন্ডার গার্ডেন স্কুল ও মাদ্রাসা। বাজার সংলগ্ন দুই পাশে রয়েছে একাধিক ইটের ভাটা এছাড়াও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এবং কিন্ডার গার্ডেনে পাশ দিয়ে রয়েছে ইটের ভাটা যা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই ক্ষতিকর। ভাটার চারপাশ দিয়ে রয়েছে জনবসতি ও ফসলি জমি। কয়েক বছর যাবত এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বছরে ছয় মাস ইট পোড়ানো হচ্ছে। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার পুখরিয়া গ্রামের প্রায় সব জায়গায় রয়েছে ইটের ভাটা। ইট প্রস্তুত ও ভাটা নিয়ন্ত্রন আইন ২০১৩ তে বলা আছে আবাসিক এলাকা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাট বাজার ও ফসলি জমির এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না। এছাড়া কোন সড়ক ও মহাসড়কের অর্ধ কিলোমিটার দূরত্বে ইট ভাটা স্থাপন করতে হবে। কিন্তু ব্যতিক্রম ব্যাপার হলো গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার পুখরিয়া গ্রামে স্থাপন করা হয়েছে অর্ধশতাধিক ইটের ভাটা।
সরোজমিনে গিয়ে দেখা যায় এখানে এক কিলোমিটারের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে দুই থেকে তিন টি ইটভাটা। গোপালগঞ্জ উপজেলায় পুখরিয়া গ্রামে পাভেল ব্রিকস নামে দুইটি, প্রগতি ব্রিকস, এবং গাজী ভাটা রয়েছে ২০১০ সালে পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র ও জেলা প্রশাসন ইট পোড়ানের লাইসেন্স। কিন্তু এসবিআই ব্রিকস,সুপার ব্রিকস, পদ্মা ব্রিকস, স্টার ব্রিকস, রাজ ব্রিকস, সোহাগ ব্রিকস, লালপরি ব্রিকস, খান ব্রিকস, গাজি ব্রিকস, বিএইসআর ব্রিকস, জাহেদা ব্্িরকস, সিটি ব্রিকস, সিটি ব্রিকস, হাশেম ব্রিকস, জেড ব্রিকস, মুন্সি ব্রিকস, শেখ ব্রিকস, শিয়ার ব্রিকস, কাজি ব্রিকসসহ প্রায় অর্ধশত ইট ভাটার ইট পোড়ানের কোন লাইসেন্স নেই। কর্তৃপক্ষের আইন অমান্য করে ইট পুড়িয়ে০ যাচ্ছে অবাধে। এমন অবস্থা গোপালগঞ্জের ৯৯%এর বেশি ইট ভাটার।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গোপালগঞ্জ জেলার পুখরিয়া গ্রামেই রয়েছে ৫৪টি ইট ভাটা। যার মধ্যে ৩টি বাদে বাকি কোন ইট ভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র ও ইট পোড়ানের লাইসেন্স নেই।
স্টার ব্রিকস এর মালিক মোজাহিদ মোল্যা বলেন, সবাই ইট ভাটা চালাচ্ছে তাই আমরা ও চালাচ্ছি তাছাড়া আমরা জেলা প্রশাসকের এল আর ফান্ডে প াশ হাজার টাকা জমা দিয়ে ভাটায় ইট পোড়ানোর কাজ শুরু করেছি। তাছাড়া আমাদের কাছ থেকে প্রতি কিস্তিতে এক লক্ষ ছাপ্পান্ন হাজার টাকা ভ্যাট নেয়া হয়। তিনি স্থানীয় কিছু নেতা ও কর্মকর্তার দোহাই দিয়ে আরো বলেন, তারা আমাদের বলেছেন কাজ করতে বাকি কাগজ তারাই ঠিক করে দেবেন। কিন্তু দুই বছর হলো প্রায় ত্রিশ থেকে চল্লিশটি ইটের ভাটা গড়ে উঠেছে যাদের কোন দপ্তরের ছাড়পত্র বা অনুমতি পত্র নেই।
জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ফরিদপুর আ লিক কার্যালয়ের উপ পরিচালক লুৎফর রহমান বলেন, ইট প্রস্তুত ও ইট ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রন আইন ২০১৩ অমান্যকারীকে কারাদন্ড দেওয়ার ও অর্থদন্ড করার বিধান রয়েছে। জনবসতি, ফসলি জমি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাট-বাজারের পাশে ইট ভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রয়োজন। অনুমোদন ছাড়া কি ভাবে ইট ভাটা স্থাপন করা হয়েছে তা আমার জানা নেই। তাছাড়া জেলা প্রশাসক ইট পোড়ানোর লাইসেন্স প্রদান করেন। তিনি চাইলে আইন অমান্যকারী ইট ভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন।
পুখরিয়া গ্রামের কেরামত আলি শেখ বলেন, পুখরিয়া গ্রামে এ বছর এবং বিগত বছর এ.পি.বি ব্রিকস, কে.এস.বি ব্রিকস, মোল্যা ব্রিকস, আয়ুব আলী ব্রিকস, লালপরি ব্রিকস, টি.এম.ব্রিকস, কিং ব্রিকস, জায়েদা ব্রিকস, হাসেশ ব্রিকস, সুপার ব্রিকস, মিতু ব্রিকস, রাজ ব্রিকস, পদ্মা ব্রিকস, কে.বি ব্রিকস, খান ব্রিকস, ভাই ভাই ব্রিকস, খান ব্রিকস, আর.এম.এন.ব্রিকস, মাস্টার ব্রিকসসহ প্রায় চল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশটি ভাটা স্থাপন করা হয়েছে। এ সকল ইট ভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র ও ইট পোড়ানোর লাইসেন্স নেই। এছাড়া এই ভাটার তৈরি করা হয়নি চিমনি। ড্রাম চিমনি দিয়ে পোড়ানো হচ্ছে ইট। প্রতিটি ইট ভাটার মাঝে স্থাপন করা হয়েছে করাত কল। করাত কল দিয়ে কাঠ চেরাই করে সেই কাঠ দিয়ে ইট পোড়ানো হয়। ইট ভাটার চারদিকে ডাল, আখ, পেয়াজ, রসুন, সবজি, ধান, গম, চাষ করতেন স্থানীয় কৃষকেরা। ইট ভাটার কালো ধোঁয়া ও ধুলাবালুতে ফসলের মারাতœক ক্ষতি হচ্ছে। এছাড়াও কালো ধোঁয়ায় নারকেল গাছের নারকেল ছোট হয়ে যাচ্ছে আম, নারকেল সুপারি ও অন্যান্য ফলন একবারেই কমে যাচ্ছে।
পুখরিয়া গ্রামের কৃষক ওসমান আলি শেখ বলেন, এ বছর আমি ৫০ শতাংশ জমিতে মশুরি এবং আবাদ করেছি। কিন্তু ইট ভাটার কালো ধোঁয়ার জন্য ও ধুলা বালিতে মসুরির ফলন ভালো হয়নি। এখন কৃষক চাষাবাদ করার জমিই পাচ্ছে না। আমাদের এলাকায় প্রায় সব জমিতে ইট ভাটা স্থাপন করা হয়েছে।
পুখরিয়া গ্রামে মনিরুল ইসলাম বলেন, জেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগ পরিদর্শন করেছে । তারা এসে বলেছেন যে সকল ভাটার লাইসেন্স নেই সে গুলো চালানোর কোন বৈধতা নেই। এমন কি যে সকল ইট ভাটার চিমনি তৈরি করা নেই ড্রাম চিমনি দিয়ে ইট পোড়াচ্ছে তারা অবশ্যই আইন বিরোধী কাজ করছে আইনের প্রতি সম্মান প্রর্দশ করে এখান থেকে কয়েকটা ভাটার চিমনি নামিয়ে দিয়েছিলেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা কিন্তু নামানোর পনের মিনিট পর ভাটার মালিকেরা নিজেদের আইনে আবার চিমনি উঠিয়ে কাজ শুরু করেন এর নেপথ্যে কি কারন তা আমাদের জানা নেই। এই এলাকায় কোন ভাটার অনুমমোদন নেই কিন্তু অবাধে ইট পুড়িয়ে যাচ্ছে। রাতের বেলা এই এলাকায় এক থেকে দেড়শত মন গাছ ট্রাকে করে আনেন এবং প্রত্যেকের নিজস্ব ভাটার মধ্যে করাত কল রয়েছে তা দিয়ে চেরাই করে কাঠ দিয়ে ইট পোড়ান। এগুলো উপর মহল দেখেন কিন্তু তাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। সমস্যায় ভুগছেন এলাকাবাসি কারন এই এলাকায় ফসলি জমিতো নেই তাছাড়া শ্বাস কষ্ট রোগ বেড়েই চলেছে।
গোপালগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপপরিচালক সমীর কুমার গোস্বামী বলেন, ইট ভাটার পরিবেশগত ছাড়পত্র দেওয়ার আগে কৃষি বিভাগ একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রদান করেন তদন্ত শেষে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা একটি প্রত্যয়ন পত্র প্রদান করে থাকেন। ফসলি জমিতে ইট ভাটা স্থাপন করতে হলে অবশ্যই কৃষি বিভাগের অনুমোদন পত্র প্রয়োজন। কিন্তু এই সমস্ত এলাকায় একর পর এক ইট ভাটা স্থাপন করে চলছে আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত কোন লোক আসেনি তবে কৃষি জমি কেটে বিগত বছর ও এই বছরে প্রায় গড়ে তোলা হয়েছে চল্লিশ থেকে পয়তাল্লিশটি ইটভাটা। এগুলো কাদের অনুমতিতে করা হয়েছে আমার জানা নেই। আমাদের খাদ্যে সয়ং সম্পূর্ন থাকতে হলে কৃষি জমি কে অক্ষত রাখতে হবে।
পুখরিয়া গ্রামের আসাদ মোল্লা বলেন, ডিসি অফিসের এল আর ফান্ডে প্রতিটি ভাটা থেকে প াশ হাজার করে টাকা নেওয়া হয়েছে এবং প্রতি কিস্তিতে এক লক্ষ আটান্ন হাজার টাকা করে বছরে মোট প্রায় পাঁচ লক্ষ টাকা আমাদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে ভ্যাট বাবদ। তাহলে অনুমোদন যদি নাই দিবেন তাহলে এই টাকা নিয়েছেন কিসের ভিত্তিতে।
পুখরিয়া গ্রামের সাগর হোসেন রানা বলেন, আমাদের গ্রামে বসবাস করার মত কোন অবস্থা নেই গ্রামের রাস্তা দিয়ে হাটা যায় ধূলা বালুর জন্য। তাছাড়া কালো ধোয়া ও ধূলা বালু ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের শারিরিক ভাবে ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। গ্রামের কোন বাড়িতেই গাছের কোন পাতা পর্যন্ত দেখা যায়না ধুলা-ময়লার ও কালো ধোয়ার জন্য। সব সময় যেন অন্ধকার অবস্থা থাকে। এখানে কোন ভাটার ইট পোড়ানোর জন্য যে চিমনির প্রয়োজন তা একটি ভাটায়ও নেই। এখানে প্রশাসনের লোক জন আসেন এসব দেখেন কিন্তু কোন পদক্ষেপ নেই। এখানে সব ইট ভাটায় ব্যাবহার করা হচ্ছে ড্রাম চিমনি ( টিন দিয়ে তৈরি করা ছোট চিমনি)। দুই একবার এই ড্রাম চিমনি গুলো প্রশাসনের লোক এসে নামিয়ে ফেললে ও প্রশাসনের লোকজন গ্রাম থেকে বের হওয়ার আগেই ড্রাম চিমনি গুলো আবার জায়গায় উঠে যায়। এর রহস্য আমরা বুজতে পারলেও বলার সাহস পাই না।
গোপালগঞ্জর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো: জাহাঙ্গির হোসেন বলেন, যে সকল ইট ভাটার লাইসেন্স নেই সে সকল ইট ভাটায় খুব দ্রæত ভেঙ্গে দেয়া হবে। গোপালগঞ্জ অনেক ভাটা রয়েছে যাদের কোন অনুমোদন নেই।
খবর৭১/এস:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here