গভীর অনিশ্চয়তায় বিশ্ব অর্থনীতি

0
440
গভীর অনিশ্চয়তায় বিশ্ব অর্থনীতি

খবর৭১ঃ

বিশ্ব জুড়ে করোনার অভিঘাতে থমকে গেছে অর্থনীতি। করোনাযুদ্ধের আগে চীন-আমেরিকান বাণিজ্যযুদ্ধ এবং তদ্পরবর্তীকালে মহামন্দায় ঢুকে পড়া বিশ্ব অর্থনীতি আজ চরম ক্রান্তিকালে। একই সঙ্গে তিন ধরনের সংকটে পড়ার ঘটনা এবারই প্রথম প্রত্যক্ষ করল বিশ্ব অর্থনীতি। চারদিকে বেকারত্ব আর ব্যবসা-বাণিজ্যের স্থবিরতা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত করে দিয়েছে অর্থনীতিকে। এর রেশ কাটিয়ে উঠতে বেশ কয়েক বছর লাগতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পূর্বাভাসেও বলা হয়েছে কোনো কোনো অর্থনীতির এবারে নেগেটিভ প্রবৃদ্ধি হবে। বড়ো অর্থনীতির দেশগুলোর অবস্থাও বেশ শোচনীয়। অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ আর সামনে এগিয়ে যাওয়া কিংবা কত শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলো, তা নিয়ে ভাবছে না। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে, খোদ যুক্তরাষ্ট্র ১৯৩০ সালের পর এরকম বেকারত্ব পরিস্থিতির মুখে পড়েনি। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম নিম্নে চলে আসা মানেই হচ্ছে অর্থনীতি এগোচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রণোদনার পর প্রণোদনা দিয়ে কোনোমতে টিকে থাকার লড়াইয়ে শামিল হয়েছে এখন বিশ্ব অর্থনীতি। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখেও পড়বে বিশ্ব। যা সামাল দেওয়া সম্ভবপর হবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এ অবস্থায় টিকে থাকতে হলে প্রণোদনা বা টাকা ছড়ানোর বিকল্প নেই। কিন্তু সব দেশের সেই সামর্থ্য নেই যে, যথেষ্ট হারে নাগরিকদের প্রণোদনা দেবে। এ অবস্থায় অনেকেই পুনরুদ্ধারের দৌড়ে পিছিয়ে পড়বে। বাড়বে দরিদ্র দেশের সংখ্যা। নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশগুলোর জন্যও যা হবে চ্যালেঞ্জিং। কেননা, উন্নত বিশ্বের কাছ থেকে আগের মতো পর্যাপ্ত অর্থ সহায়তা মিলবে না। এমনকি কোনো কোনো দেশ বাজেট সাপোর্টও পাবে না।

পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে, এমন কোনো খাত নেই যা সহজে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। মার্কিন বিনিয়োগকারী ওয়ারেন বাফেট ইউএস এয়ারলাইন্সে তার শেয়ার বিক্রি করার কথা বলেছেন। এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রির কোনো ইতিবাচক ভবিষ্যত্ তিনি দেখছেন না। একইভাবে অনেক খুচরা বিক্রেতা বা রিটেইলার চেইনশপও বিক্রির অফার করা হচ্ছে। বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বহু শিল্পকারখানা। ব্যাংক ঋণ নিয়েও ব্যবসায় টিকে থাকা যাবে না এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই বাণিজ্যিক ঋণ গ্রহণ থেকেও বিরত থাকছেন। কেউ বিশ্বাস করছেন না সহসা অর্থনীতিতে গতি ফিরবে। সে রকম কোনো লক্ষণ তো নেই, বরং করোনার প্রাদুর্ভাব এখনো থামেনি। বন্ধ রয়েছে সব অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ।

সর্বশেষ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে কেউ কেউ বলেছেন, ২০২৩ সালের আগে পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় গতি আসবে না। এরই মধ্যে ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের সবাই কাজের সুযোগও পাবেন না। উন্নত দেশগুলোতে সামাজিক নিরাপত্তা সুবিধার আওতায় থাকলেও নিম্ন আয়ের দেশগুলোর বেকাররা দরিদ্রসীমার নিচে নেমে যাবে। এসব বলা হলেও বাস্তবে করোনা ভাইরাস অর্থনীতিতে কতটা ক্ষতি করতে পারে সেটি অননুমেয়। কারণ, ইতিমধ্যে বিশ্বের বড়ো অর্থনীতির দেশগুলো অর্থনীতির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নানা প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। কিন্তু মন্দার কবল থেকে পরিত্রাণ মিলছে না তাদেরও। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বেকার ভাতার আবেদন ৩ কোটি ছাড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় সুদ হার শূন্যের কাছাকাছি নামিয়ে আনা ছাড়াও দেশটি ২৮৮ লাখ কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণার পরেও নতুন করে আরো প্রণোদনার বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এর পরেও এবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি না হয়ে বরং ৪ দশমিক ৮ শতাংশ সংকোচন ঘটবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে দেশটি।

বিবিসির সংবাদ অনুযায়ী, জিডিপির এই সংখ্যা দেশটির অর্থনীতির দুরবস্থা পুরোপুরি প্রকাশ করছে না। শুধু মার্কিন অর্থনীতিই নয়, মন্দার গভীরতা কতটা হবে সেটি নিয়েই চিন্তিত এখন পুরো বিশ্ব। করোনা ভাইরাসের উত্স ভূমি চীনের অর্থনীতি প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) ৬ দশমিক ৮ শতাংশ সংকোচন ঘটেছে। গত বুধবার জার্মানির অর্থমন্ত্রী পিটার অলটমায়ার বলেছেন, দেশটির অর্থনীতিতে এবছর সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৩ শতাংশ সংকোচন ঘটতে পারে। জার্মানির ইতিহাসে ১৯৪৯ সালের পর এত ক্ষতি কেউ কখনো দেখেনি। এবছরের প্রথম প্রান্তিকে ফ্রান্সের জিডিপি কমেছে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। ইউরোপের অপর দুই বড়ো অর্থনীতির দেশ স্পেনে ৫ দশমিক ১ শতাংশ এবং ইতালি ৪ দশমিক ৭ শতাংশ সংকোচন হয়েছে। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের (ইসিবি) প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিনা ল্যাগার্ড বলেছেন, ইউরোপজুড়েই অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে গেছে। ফলে এবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকেও অর্থনীতি আরো খারাপ হতে পারে। সবমিলিয়ে এবছর ইউরোপের অর্থনীতি ৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত সংকোচন হতে পারে বলেও পূর্বাভাস দেন তিনি।

শুধু ইউরোপ বা আমেরিকার অর্থনীতিই নয়, মন্দার অভিঘাত চলছে সারাবিশ্বেই। অবশ্য চীন, ভারতের মতো জনবহুল দেশে জিডিপি সংকোচন না হলেও প্রবৃদ্ধি খুব একটা হবে না সেটা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থা এরই মধ্যে পূর্বাভাস দিয়েছে। বাংলাদেশেও প্রবৃদ্ধি হার ২ শতাংশে নেমে আসার কথা বলেছে সংস্থাগুলো। তবে প্রবৃদ্ধির এই অঙ্ক গোনার চেয়ে এখন বড়ো কথা মানুষকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখা। সুস্থসবল কর্মীবাহিনীই আগামীর অর্থনীতিকে এগিয়ে নেবে। তবে এজন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আর্থিক সহায়তা। এই সংকটে উন্নত দেশগুলোর কৌশলও তাই। যারাই অর্থ ঢেলে, প্রয়োজনে টাকা ছাপিয়ে টিকে থাকার লড়াইটা চালিয়ে যেতে পারবে, তারাই সফলকাম হবে। তবে এই লড়াইটা কবে শেষ হবে তা কেউ জানে না। কারণ, ১৯৩০ এর দশকে মহামন্দার পর বিশ্বে এ ধরনের দুর্যোগ কখনো আসেনি। কাজেই সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এখুনি প্রস্তুতি শুরু করে দিতে হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here