কাঁঠালবাড়ী-শিমুলিয়া নৌরুটে যাত্রীদের সারা বছরই দুর্ভোগ

0
332

এস. এম. রাসেল, মাদারীপুর: কাাঁঠালবাড়ী-শিমুলিয়া নৌরুটে চলাচল করা যাত্রীদের সারা বছরই বিড়ম্বনা পোহাতে হয়। প্রতিদিন সরকার এ রুট থেকে প্রায় কোটি টাকা রাজস্ব পেলেও ভোগান্তি লাঘবে স্থায়ীভাবে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। তা ছাড়া দুর্ভোগে পড়া যাত্রীদের নিয়ে স্থানীয় ঘাট সংশ্লিষ্টরা নানা রকম ধান্দাবাজি করে।
সরজমিনে গতকাল সকালে কাঁঠালবাড়ী ফেরি ঘাটের জিরো পয়েন্ট থেকে ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের দীর্ঘলাইন গাড়ির সিরিয়াল দেখা যায়। প্রায় ৩ কিলোমিটার জুড়ে সাড়ে ৩ শতাধিক বাস-ট্রাক ও ছোট-বড় যানবাহন আটকে থাকতে দেখা যায়। এ চিত্র প্রতিদিন কাাঁঠালবাড়ী ফেরি ঘাটে দেখা যায় বলে স্থানীয়রা জানান। রাজধানী ঢাকার সাথে দক্ষিণ বঙ্গের মানুষের সড়ক পথে যোগাযোগের দেশের অন্যতম নৌরুট কাাঁঠালবাড়ী-শিমুলিয়া। প্রতিদিন দক্ষিণবঙ্গের ১৯টি জেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের প্রায় ৪০ হাজার যাত্রী এ রুটে যাতায়াত করেন। এ ছাড়া এ দুই ঘাটে প্রতিদিন ছোট-বড় মিলে ৫ থেকে ৬ হাজার গাড়ি ফেরিতে নদী পারাপার হয়। সারা বছর এ সব গাড়ির যাত্রীদের কোনো না কোনো কারণে কাাঁঠালবাড়ী-শিমুলিয়া ঘাটে যানজটে আটকা পড়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা সঙ্কট, বর্ষায় নদী ভাঙন, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, শীতে ঘন কুয়াশাসহ কোনো না কোনো সমস্যা থাকে। তা ছাড়া দুর্বল ফেরির ইঞ্জিন, ভাঙ্গা পন্টুন, ঘাট সড়ান, ড্রেজিং সঙ্কটসহ হাজারো রকম সঙ্কটতো আছেই। এ রুটে চলাচল করার সব সময়ই কাাঁঠালবাড়ী-শিমুলিয়া ঘাটে ভোগান্তির শঙ্কা মাথায় নিয়েই চলাচল করেন।
বিআইডব্লিউটিসি সূত্রে জানা যায়, দুই ঘাট মিলে প্রতিদিন এ রুটে প্রায় ৩৫-৪০ হাজার যাত্রী এবং প্রায় হাজার ছোট-বড় যানবাহন পারাপার হয়। এতে সরকারের ৭০ থেকে ৮০ লাখ টাকা প্রতিদিন রাজস্ব আয় হয়। সরকার এ রুট থেকে প্রায় কোটি টাকা রাজস্ব পেলেও ভোগান্তি লাঘবে স্থায়ীভাবে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।
সরজমিনে সকালে কাঁঠালবাড়ী ফেরি ঘাট ঘুরে দেখা যায়, পৃথিবীতে আসার মাত্র ৩ দিনের মাথায় অসুস্থ নবজাতক মাহমুদ হুসাইনকে বুঝতে হলো শিমুলিয়া-কাঠালবাড়ি নৌরুটের অচলাবস্থার ভোগান্তি। পরিবারের স্বজনরা অসুস্থ মাহমুদকে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য শরীয়তপুর থেকে ঢাকায় নেয়ার পথে কাঁঠালবাড়ি ঘাটে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে থেকে পরে ফেরৎ যেতে বাধ্য হয়। অসুস্থ এই শিশুর শরীরের ঘামই যেন বলে দিচ্ছিল ভোগান্তির ভয়াবহ চিত্র। একই সময় ঘাটে অন্তত ৪টি এ্যাম্বুলেন্স জরুরী রোগী নিয়ে আটকে পড়ে। রাজৈরের চৌরিবাড়ী থেকে আগত অসুস্থ রোগী সবরি বাড়ৈ, বৃদ্ধ নিজাম মালসহ ৪ টি এ্যাম্বুলেন্সই ফেরি না পেয়ে ফেরৎ যেতে বাধ্য হয়। পানি কমে নাব্যতা পরিস্থিতির অবনতিতে এ নৌপথে রাতে বন্ধ থাকছে ফেরি চলাচল। ২ দিন বন্ধ থাকার পর শনিবার সকাল থেকে ৪/৫ টি কেটাইপ ফেরি চলাচল করলেও সন্ধার পর সকল ফেরি আবারো বন্ধ হয়ে যাবে বলে বিআইডব্লিউটিসি জানিয়েছে। এতে ঘাট এলাকায় যানবাহনের দীর্ঘ যানজটের চিত্রর সাথে সাথে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে জরুরী এ্যাম্বুলেন্সসহ সকল সার্ভিস।
বিআইডব্লিউটিএ,বআিইডব্লিউটিসি সহ একাধিক সূত্রে জানা যায়, দূর্ভোগের শুরু ¯্রােতের গতিবেগ তীব্র আকার ধারন করায় এ রুটের লৌহজং টার্নিং এ ঘূর্নি¯্রােত সৃষ্টি হয়ে ১০ জুলাই থেকে নৌরুটে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে তৈরি বিকল্প চ্যানেল চালু হয় ১৬ জুলাই। কিন্তু যানবাহন বোঝাই একটি ডাম্ব ফেরি ডুবোচরে ধাক্কা লেগে তলা ফেটে ডোবার উপক্রম হলে ৭ আগষ্ট নতুন চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে লৌহজং টার্নিং হয়েই অনেকটা ওয়ানওয়ে পদ্ধতিতে ফেরি চলছিল। ঈদের আগে পরেও ভোগান্তিতে পড়তে হয় যাত্রী ও শ্রমিকদের। এরপর ঘূর্নি ¯্রােত তীব্র ¯্রােত পানি বৃদ্ধিতে সংকট ছিল দীর্ঘদিন। গত ২৪ ঘন্টায় ৭ সে.মি. পানি কমে সবশেষ গত ৬ দিনে পানি কমেছে ১২৫ সে.মি। দ্রুত পানি কমতে থাকায় লৌহজং টার্নিং এর আধা কিলোমিটার জুড়ে বড় ধরনের চর জেগে উঠে ক্রমান্বয়ে তা বিস্তৃতি হচ্ছে। ৬ দিন ধরে রাতে বন্ধ আর দিনে প্রায় অচল এ নৌরুটটি। হালকা যানবাহন নিয়েও কম ড্রাফটের ৪/৫টি কেটাইপ ফেরিগুলো চলতে হিমশিম খাচ্ছে। বন্ধ রয়েছে রো রো ও ডাম্ব ফেরি। পানি কমার গতিবেগ বেশি থাকায় দ্রুত নাব্যতা হারাচ্ছে নৌপথের দীর্ঘ অংশ। ৮টি ড্রেজার ড্রেজিং করেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক আনতে পারছে না। এতে সংশয় আরো বেড়ে গেছে। দ্রুত নৌপথজুড়ে নাব্যতা হারানোয় শংকা বাড়ছে নৌ চলাচল নিয়ে।
সরেজমিনে কাঠালবাড়ি ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, ফেরিশুন্য ঘাটে আটকা শত শত যানাবহনের মাঝে ৪টি এ্যাম্বুলেন্স বার বার জরুরী সাইরেন বাজিয়েও কোন সাড়া পাচ্ছেন না। বেশ কয়েক ঘন্টা প্রতিক্ষার পর এক পর্যায়ে সেগুলো রোগী নিয়ে অন্য রুটে চলে যায়। এ সুযোগে গেন্ডারী এক্সপ্রেস সহ কয়েকটি বাস ঢাকার যাত্রী এনে বাস ঘাটে রেখে হেল্পার ড্রাইভার সটকে পড়েছেন। তবে বেশির ভাগ বাস সার্ভিস বিকল্প রুট বা লে কাটা সার্ভিসে যাত্রী সেবা দিচ্ছেন। ট্রাকের দীর্ঘ সিরিয়াল রয়েছে ৭ দিনেরও বেশি। ট্রাক শ্রমিকরা অবর্ননীয় দূর্ভোগ পোহাচ্ছেন।
ঘাটে আটকা এ্যাম্বুলেন্সে ৩দিনের নবজাতক মাহমুদের মা মাহমুদা আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, গত ২দিন ধরে আমার বাচ্চাটা কিছু খায় না কম নড়াচড়া করে তাই ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু ঘাটে এসে ঘন্টার পর ঘন্টা আটকে আছি। দেখেন না ভাই ফেরি কখন আসবে।
আরেক রোগী সবরি বাড়ৈর বোন কবরি বলেন, আমার বোন খুব অসুস্থ হওয়ায় ঢাকায় নিচ্ছি। সকাল থেকে ঘাটে অপেক্ষা করছি। কিন্তু ফেরি চলছে না।
ট্রাক চালক আশরাফ হোসেন বলেন, কলা বোঝাই ট্রাক নিয়ে আজ ২ দিন ধরে কাঁঠালবাড়ি ঘাটে আটকে আছি। কলায় পচন ধরতে শুরু করেছে। অনেক ট্রাক ৭ দিনের বেশি ঘাটে আটকে আছে। সবাই খুব কষ্টে আছি।
ড্রেজার মাস্টার হাবিবুর রহমান বলেন, লৌহজং টার্নিংয়ে তীব্র ¯্রােত রয়েছে। সেই সাথে প্রচুর পরিমানে পলি ভেসে এসে চ্যানেলের মুখে পড়ে চর সৃষ্টি করছে। আমরা ড্রেজিং করার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই পলি পড়ে চ্যানেল ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
কেটাইপ ফেরি কুমিল্লা মাস্টার ইনচার্জ ফিরোজ হোসেন মুঠোফোনে বলেন, নদীতে দ্রুত পানি কমছে। লৌহজং টার্নিং, চায়না চ্যানেল টার্নিং এ যে পরিমান পানি আছে তাতে কোন ফেরি তলদেশ ঘেসে কোনমতে চলছে। মাত্র ৪টি ফেরি ২টি করে ট্রীপ দিতে পেরেছি । দুপুরে চায়না টার্নিং এ ড্রেজিং এর জন্য ফেরি বন্ধ রাখা হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিসির কাঠালবাড়ি ঘাট সহকারী ম্যানেজার মোঃ জসিমউদ্দিন বলেন, ড্রেজিং এর সুবিধার্থে শুক্রবার দুপুর থেকে আবারো ফেরি সার্ভিস বন্ধ রয়েছে।
মাঝ নদীতে কর্তব্যরত বিআইডব্লিউটিএ ড্রেজিং বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আ.স.ম মাশরেকুল আরেফিন বলেন, আমরা সর্বোচ্চ সংকটকালীন সময় পার করছি। পদ্মায় একদিকে দ্রুত পানি কমছে, অপরদিকে দ্রুত পলি পড়ছে। ৮টি ড্রেজার ড্রেজিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে । শীঘ্রই সমস্যার সমাধান হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here