করোনাকালে বিনা চিকিৎসায় ‍মৃত্যুর অভিযোগ বাড়ছে

0
437
৭২ ঘণ্টা উপসর্গ না থাকলে টেস্ট ছাড়াই রিলিজ

খবর৭১ঃ শত অনুনয়েও করোনার টেস্ট ছাড়া ভর্তি করছে না কেউ, মুমূর্ষু রোগী নিয়ে অসহায় স্বজনরা ছুটছেন এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে৷ এক পর্যায়ে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন রোগী৷ তাদের মৃত্যুর কারণ কিন্তু করোনা ভাইরাস নয়৷

দেশে প্রথম করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শনাক্তের পর গত দুই মাসে অনেকে এভাবে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে৷ কিছু মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমে উঠে এসেছে৷ কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বজন হারানোর বেদনার কথা তুলে ধরেছেন, প্রকাশ করেছেন ক্ষোভ৷ কিছু মৃত্যু আড়ালেই রয়ে যাচ্ছে৷

গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়৷ তারপর দিন দিন বাড়ছে সংক্রমণ, মৃত্যুর মিছিলও বড় হচ্ছে৷ সরকার শুরুতে প্রস্তুতি থাকার কথা বললেও স্বাস্থ্যখাতে প্রস্তুতির অনেক ঘাটতি দেখা যাচ্ছে৷

দেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল একাত্তর-এ সদ্য স্বজনহারা সাইফুদ্দিন নাসির নামে এক ব্যক্তি নিজের ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতার কথা জানান৷

সাইফুদ্দিনের স্ত্রীর বড় বোন রেবেকা সুলতানা (৪৫) দুই সন্তান নিয়ে ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বসবাস করতেন৷ কিডনি রোগে আক্রান্ত এ নারীকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে হতো৷ বরাবরের মতো ৭ মে সকালেও রাজধানীর বিআরবি হাসপাতালে ডায়ালিসিস করাতে গিয়েছিলেন৷ কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে জানান, রেবেকা সুলতানার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে৷ তাদের হাসপাতালে হৃদরোগের চিকিৎসা হয় না, তাই ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে যেতে বলা হয়৷

সাইফুদ্দিন বলেন, ‘সকাল ৯টার দিকে ফোন পেয়ে আমি বিআরবি হাসপাতালে যাই৷ তারা আমাদের হাসপাতাল ছাড়তে বাধ্য করে৷ অ্যাম্বুলেন্সে রোগীকে নিয়ে যাই হার্ট ফাউন্ডেশনে৷ তারা বলেন, তাদের ওখানে ডায়ালিসিসের ব্যবস্থা নেই, তাই রোগী ভর্তি রাখবে না৷ সেখানে থেকে গেলাম স্কয়ার হাসপাতালে৷ তারা বললো, তাদের আইসিইউ খালি নেই৷

‘আয়শা মেমোরিয়ালে যোগাযোগ করলে তারা বললেন, করোনার টেস্ট ছাড়া রোগী ভর্তি করবে না৷ গেলাম ইমপালস হাসপাতালে৷ তারা বললেন, তাদের ওখানে অনেক করোনা রোগী ভর্তি আছেন, নতুন রোগী রাখবেন না৷ নিরুপায় হয়ে বারডেম হাসপাতালে গেলে ডাক্তার রোগীকে পরীক্ষা করে আইসিইউতে ভর্তি করাতে বললেন৷ কিন্তু আইসিইউর দায়িত্বে থাকা ডাক্তাররা টেস্ট ছাড়া ভর্তি করাতে রাজি হলেন না৷ অনেক অনুনয় করেছি, তদবিরও করিয়েছিলাম৷ কিন্তু কিছুতেই কাজ হলো না৷ বিকাল চারটার দিকে রোগী মারা যান৷ হাসপাতাল থেকে হৃদরোগে মৃত্যু হয়েছে বলে সনদ দেয়া হয়৷’

এক দিন আগে রাজধানীর মুগদা জেনারেল হাসপাতালের সামনে প্রায় একই ধরনের একটি ঘটনার খবর আসে স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে৷ সেখানে এক নারী ছোট ভাইয়ের করোনা টেস্টের রিপোর্ট নিতে এসেছেন৷ ওই নারী জানান, বক্ষব্যাধিতে ভোগা তার ৩৮ বছরের ভাই সাতদিন আগে হঠাৎ করেই মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েন৷

‘‘অনেক হাসপাতাল ঘুরেছি, কিন্তু কেউ ভর্তি করতে রাজি না৷ পরে মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতাল বলেছে, কারোনা পরীক্ষার রিপোর্ট পেলে ভর্তি করবে৷ তাই রিপোর্ট নিতে আসছি৷’

রিপোর্ট দেওয়ার নির্ধারিত সময়ের আগেই লাইনে দাঁড়ানো এ নারী বারবার ফোন করে ভাইয়ের খবর নিচ্ছিলেন৷ এক সময় খবর আসে তার ভাই আর বেঁচে নেই৷

ভাইয়ের করোনা রিপোর্ট ‘নেগেটিভ’ এসেছে৷ অর্থাৎ, তার ভাই করোনায় আক্রান্ত ছিলেন না৷ রিপোর্ট হাতে ওই নারী চিৎকার করে বলছিলেন, ‘এই রিপোর্ট দিয়ে আমি এখন কী করবো? আমার ভাই তো আর বেঁচে নেই৷ এই রিপোর্টের জন্য কেউ ভর্তি করলো না৷’

গত ৩১ মার্চ তারেক রিপন নামে আরেক ব্যক্তি ফেসবুকে স্ট্যাটাসে জানিয়েছিলেন, তার বোনের স্বামীকে নিয়ে ১০ দিন ধরে নানা হাসপাতালে ঘুরেও কোনো চিকিৎসা পাননি৷ অথচ ওনার করোনা পরীক্ষার ফলাফল ‘নেগেটিভ’ ছিল৷ বাড়িতে চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করেও রোগীকে বাঁচানো গেল না৷

সাভারের হেমায়েতপুরের জয়নালবাড়ী এলাকার জসিম উদ্দিনকে (৫২) একই ভাগ্য বরণ করে নিতে হয়৷ গত ১৩ এপ্রিল মারা যান তিনি৷ মৃত্যু সনদে লেখা হয় ‘স্ট্রোক’৷ অথচ করোনা আতঙ্কে পাঁচটি হাসপাতাল তাকে চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল৷

সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল হয়ে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, তারপর কুর্মিটোলা জেনারেল ‍হাসপাতাল৷ কুর্মিটোলার ডাক্তাররা করোনা উপসর্গ নেই বলে রোগী ভর্তি করেনি৷ নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে৷ কিন্তু সেখানেও চিকিৎসা দেওয়া হয়নি৷ পরে মহানগর হাসপাতালে ভর্তির কিছুক্ষণ পর তিনি মারা যান৷

অবহেলায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ এনে ইউনাইডেট হাসপাতালের বিরুদ্ধে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন ডা. জিয়াউদ্দিন হায়দার৷ তিনি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক৷

গত ৫ এপ্রিল তার মায়ের নিউমোনিয়া লক্ষণ এবং শ্বাসকষ্ট শুরু হলে প্রথমে পরিবারের তিন ডাক্তার সদস্য বাড়িতে রেখেই রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছিলেন৷ কিন্তু অবস্থার অবনতি হলে উত্তরায় পরিচিত একটি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়৷ করোনা পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এলে ১২ এপ্রিল ভর্তি করা হয় ইউনাইটেড হাসপাতালে৷ রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা অনেক কমে যাওয়ায় সেখানে তিনি লাইফসাপোর্টে ছিলেন৷

দ্বিতীয় পরীক্ষায় ফল ‘পজিটিভ’ এসেছে জানিয়ে ১৪ এপ্রিল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার মায়ের লাইফ সাপোর্ট খুলে নিয়ে তড়িঘড়ি ছাড়পত্র দিয়ে তাদের চলে যেতে বাধ্য করেন৷ এমনকি ভেন্টিলেটর সুবিধা সম্পন্ন কোনো অ্যাম্বুলেন্সও তাদের দেওয়া হয়নি৷ –ডয়চে ভেলে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here