ওষুধের নামে প্রেসক্রাইব করা হচ্ছে ‘ফুড সাপ্লিমেন্ট’

0
436

খবর৭১: দিনমজুর আবুল কালাম বেশকয়েক দিন ধরে কোমর ব্যথায় ভুগছেন। ফার্মেসি থেকে বিভিন্ন সময়ে ওষুধ কিনে খেয়েও লাভ হয়নি। দিন দিন ব্যথা বেড়েই চলেছে। অথচ মাসখানেক ধরে কাজ করতে না পারায় অর্ধাহারে-অনাহারে দিন চলছে তার। তারপরও অনেক কষ্টে হাজার খানেক টাকা জোগাড় করে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালের বহির্বিভাগে যান।

চিকিৎসক তাকে ছয়টি ওষুধ প্রেসক্রাইব করেন। এর মধ্যে তিনটিই বিদেশী ফুড সাপ্লিমেন্ট। ফার্মেসিতে কিনতে গেলে দোকানদার কত টাকা আছে জিজ্ঞেস করে। তারপর তাকে দুটি ফুড সাপ্লিমেন্ট ধরিয়ে দেয়। আবুল কালামও সেগুলো নিয়মিত খেতে থাকে কিন্তু ব্যথা কমার কোন লক্ষণই নেই।

প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রায় ছয়-সাতশ রোগী জাতীয় অর্থোপেডিক ও পুনর্বাসন (পঙ্গু) হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসেন। এদের মধ্যে শতকরা নব্বই ভাগ রোগীই অস্বচ্ছল। স্বল্পমূল্যে উন্নত চিকিৎসার আশায় থাকলেও চিকিৎসকদের ফুড সাপ্লিমেন্ট লেখার প্রবণতার কারণে তারা প্রতারিত হচ্ছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, অর্থোপেডিক বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি (এমএস অর্থো) গ্রহণের জন্য চিকিৎসকগণ পঙ্গু হাসপাতালে আসেন। এ সময় এসব চিকিৎসক সান্ধ্যকালীন চেম্বার করার অনুমতি পান না। এই আর্থিক লোকসান পুষিয়ে নিতেই তারা ফুড সাপ্লিমেন্টকে প্রেসক্রিপশন করার দিকে ঝুঁকে পড়েন। আবার এসব ফুড সাপ্লিমেন্টের বিক্রয় প্রতিনিধিরা চিকিৎসকদের সাথে মাসিক, সাপ্তাহিক এমনকি দৈনিক ভিত্তিতেও চুক্তি করে। চুক্তির টাকা সবসময় অগ্রিম দিতে হয়। তারপর সেই বিক্রয় প্রতিনিধিরা চেম্বারের বাহিরে দাঁড়িয়ে তাদের প্রেসক্রিপশন বুঝে নেন। আর রোগীও তাদের কষ্টের টাকায় আসল ওষুধের পরিবর্তে এ সকল ফুড সাপ্লিমেন্ট কিনে বাড়ি ফিরে যান।

ওষুধের নামে এভাবে দেশজুড়েই চলছে ফুড সাপ্লিমেন্টের জমজমাট ব্যবসা। দেশের প্রায় অধিকাংশ সরকারি হাসপাতাল কোন কোন ক্ষেত্রে স্বনামধন্য আধা-সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরাও এগুলোকে ওষুধ হিসেবে প্রেসক্রিপশনে লিখে দিচ্ছেন ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০০ সাল থেকে আমদানি হচ্ছে ফুড সাপ্লিমেন্ট। প্রথম দিকে কেবল ‘ভিটামিন’ ও ‘ক্যালসিয়ামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। পরে এর পরিধি বাড়তে থাকে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে ড্রাম অথবা বস্তাভর্তি খাদ্য হিসেবে ফুড সাপ্লিমেন্ট আমদানি করা হয়। এর জন্য বিএসটিআই কিংবা ওষুধ প্রশাসনের অনুমোদন নিতে হয় না। দেশে এনে এগুলো ওষুধ হিসেবে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে।

আমদানি হয় কানাডা, ফিনল্যান্ড, চীন, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, তাইওয়ান ও ভারত থেকে। তবে অবৈধ পথেই আসে সবচেয়ে বড় চালান। আর তা আসে ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত দিয়ে। এর মধ্যে বেশি ওষুধ আসে ভারত থেকে।

ব্যবস্থাপত্রে ফুড সাপ্লিমেন্ট না লেখার জন্য দুই বছর আগেই চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠনের কাছে চিঠি দেয় ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর। লক্ষ্য ছিল ভেজাল ও নিম্নমানের এসব ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রি বন্ধ করা। কিন্তু এর পরও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন ওষুধের দোকানে বিক্রি হচ্ছে ফুড সাপ্লিমেন্ট। চিকিৎসকরাও তাদের ব্যবস্থাপত্রে এসব লিখে যাচ্ছেন।

মিটফোর্ড এলাকার ওষুধ বিক্রেতা মুরাদ আহমেদ  জানান, হাসপাতালের বহির্বিভাগে আসা অধিকাংশ রোগীর ব্যবস্থাপত্রে চিকিৎসকদের পছন্দের কোম্পানির ফুড সাপ্লিমেন্ট লেখা থাকে। মাঝে মাঝে গরীব রোগী দেখলে আমরা তাদের সেগুলো কিনতে বারণ করি। কিন্তু চিকিৎসকের প্রতি অগাধ বিশ্বাস থাকার কারণে রোগীরা আমাদেরকে ভুল বোঝেন। আর রোগীরা নিতে চাইলে আমরাও তা বিক্রি করতে বাধ্য হই। একটি কৌটা বিক্রি করে দোকানিদের প্রায় ২০০-৩০০ টাকা লাভ হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধবিদ্যা অনুষদের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক এ প্রসঙ্গে বলেন, মানুষের শরীরে কোনো ভিটামিনের অভাব দেখা দিলে সেটি গ্রহণ করলেই যথেষ্ট। কিন্তু বাজারে যে প্রচলিত ফুড সাপ্লিমেন্ট বিক্রি হচ্ছে, তা মানুষের আদৌ প্রয়োজন নেই। গরিব রোগীরা এতে প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে এ বিষয়ে বলেন, দুষ্কৃতকারী ও লোভী কিছু চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে ফুড সাপ্লিমেন্ট লিখেই যাচ্ছেন। এরা দেশ ও জাতির শত্রু। এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা হবে।

বাংলাদেশ কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির একজন সাবেক নেতা জানান, বাজারে হাতেগোনা পাঁচ-ছয়জন আমদানিকারক রয়েছে, যারা উন্নত দেশ থেকে ফুড সাপ্লিমেন্ট এনে বাজারজাত করছেন। তবে দেশের ভেতরে দেড়শতাধিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এরা বিদেশি ফুড সাপ্লিমেন্টের কৌটায় ভরে তা চড়া দামে বিক্রি করছেন। এতে সাধারণ জনগণ শারীরিক ও আর্থিক উভয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
খবর৭১/জি:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here