আমাজনের দাবানলঃ কতটা উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে

0
744
আমাজনের দাবানল: কতটা উদ্বেগজনক হয়ে উঠছে

খবর৭১ঃ দগ্ধ ‘বিশ্বের ফুসফুস’ বলে খ্যাত আমাজন। প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে পুড়ছে এর অরণ্য। ফলে উদ্বেগও বাড়ছে। আমাজনকে বাঁচাতে উদ্যোগী পুরো বিশ্ব। কিন্তু আলোচনাতেই ব্যস্ত সবাই। কেবল গাছপালা পুড়ে বিপুল পরিমাণ কার্বনডাই অক্সাইড বাতাসে মেশা নয়, আরো বড় বিপদ অপেক্ষা করছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের আশংকা মাটিতে মিশে থাকা কার্বণ কণাও পুড়ে কার্বন ডাই অক্সাইডরূপে মিশে যেতে পারে বাতাসে। প্রবল সমালোচনার মুখে অবশেষে উদ্যোগ নিতে শুরু করেছে ব্রাজিল। সেখানে সেনাবাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটি। আর বলিভিয়া বিমান থেকে পানি ঢালছে। খবর বিবিসির।

ব্রাজিলে আমাজনের জঙ্গলে হাজার হাজার জায়গায় আগুন জ্বলছে। গত এক দশকে এত ব্যাপক মাত্রায় সেখানে দাবানল সৃষ্টি হয়নি। সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে উত্তরাঞ্চলে রোরাইমা, একার, রনডোনিয়া এবং আমাজোনা রাজ্য ও মাতো গ্রোসো ডো সুল এলাকাতে। তবে সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু ছবি আপলোড করেছেন অনেক বিখ্যাতরা যা কয়েক দশকের পুরানো বলে প্রমাণিত হয়েছে এবং অনেক ছবি আদৌ ব্রাজিলের নয় বলে সমালোচনা শুরু হয়েছে।

এ বছর আগুন লাগার ঘটনা বেশি

২০১৯ সালে ব্রাজিলের স্পেস এজেন্সির তথ্যানুযায়ী, ব্রাজিলে আমাজনের উষ্ণমন্ডলীয় বনাঞ্চলে রেকর্ডসংখ্যক দাবানলের ঘটনা ঘটেছে। দ্য ন্যাশানাল ইন্সটিটিউট ফর স্পেস রিসার্চ (আইএনপিই) বলেছে, তাদের উপগ্রহ থেকে সংগৃহীত তথ্যে দেখা যাচ্ছে ২০১৮ সালে একই সময়ের তুলনায় এ বছর আগুন লাগার ঘটনা ৮৫ ভাগ বেড়েছে। সরকারি হিসাব বলছে, এবছরের প্রথম আট মাসে ব্রাজিলের জঙ্গলে ৭৫ হাজারের বেশি দাবানল হয়েছে। ২০১৩ সালের পর এই সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। পুরো ২০১৮ সালে বনাঞ্চলে মোট আগুন লাগার সংখ্যা ছিল ৩৯ হাজার ৭৫৯। শুকনো মৌসুমে আমাজনের জঙ্গলে দাবানল একটা প্রচলিত ঘটনা। সেখানে শুকনো মৌসুমের সময়কাল জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। এই দাবানল তৈরি হতে পারে প্রাকৃতিক কারণে, যেমন বাজ পড়লে। কিন্তু কৃষক এবং কাঠুরেরাও ফসল উত্পাদনের জন্য অথবা পশু চরানোর জন্য জমি পরিষ্কার করার কারণে জঙ্গলে আগুন দিয়ে থাকে।

আন্দোলনকারীরা বলছেন, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জেয়ার বলসোনারোর পরিবেশবিরোধী কথাবার্তা এভাবে জঙ্গল সাফ করার কাজকে আরো উত্সাহিত করেছে। এর জবাবে বলসোনারো এর দায় চাপিয়েছেন বেসরকারি সংস্থাগুলোর ওপর। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তি। তিনি বলেছেন, বেসরকারি সংস্থাগুলো সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য নিজেরাই এই আগুনগুলো লাগিয়েছে। পরে অবশ্য তিনি স্বীকার করেছেন যে এই দাবানল বন্ধ করার মতো সম্পদ সরকারের হাতে নেই। তবে সমালোচনার মুখে শুক্রবার প্রেসিডেন্ট বলসোনারো এক আদেশে সেনা মোতায়েনে বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব দিয়েছেন ব্রাজিলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফার্নান্দো আজভেদোকে।

সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চল

রোরাইমা, একার, রনডোনিয়া এবং আমাজোনাস্ সব এলাকাতেই গত চার বছরের (২০১৫-২০১৮) তুলনায় গড়ে আগুন লাগার ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। রোরাইমাতে দাবানলের ঘটনা বেড়েছে ১৪১ ভাগ, রনডোনিয়াতে ১১৫ ভাগ এবং আমাজোনাসে ৮১ ভাগ। দক্ষিণে মাতো গ্রোসো ডো সুল রাজ্যে আগুন লাগার হার বেড়েছে ১১৪ ভাগ। ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় রাজ্য আমাজোনাস্ জরুরি অবস্থা জারি করেছে। জ্বলন্ত আগুন থেকে পরিমাণে ধোঁয়া ও কার্বন নির্গত হচ্ছে। আগুন থেকে সৃষ্ঠ ধোঁয়া আমাজনের গোটা এলাকাজুড়ে এবং আশেপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের কোপারনিকাস অ্যাটমসফিয়ার মনিটরিং সার্ভিসের (ক্যামস্) তথ্য অনুযায়ী, এই ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে আটলান্টিকের উপকূল পর্যন্ত। এমনকি ৩২০০ কিলোমিটারেরও বেশি দূরে সাও পাওলোর আকাশ এই ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে গেছে। আগুন থেকে ব্যাপক পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হচ্ছে যার পরিমাণ এ বছর ২২৮ মেগাটনের সমপরিমাণ দাঁড়িয়েছে। ক্যামস্ বলছে, এই পরিমাণ ২০১০ সালের পর সবচেয়ে বেশি। ধোঁয়া থেকে কার্বন মনোক্সাইডও নির্গত হচ্ছে।

ক্যামস্’র প্রকাশ করা মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে, খুবই চড়া মাত্রায় বিষাক্ত এই গ্যাস কার্বন মনোক্সাইড দক্ষিণ আমেরিকার উপকূল ছড়িয়ে এখন আরো দূরে ছড়িয়ে পড়েছে। আমাজন অরণ্যাঞ্চলে ৩০ লাখ প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ রয়েছে। সেখানে বসবাস করেন ১০ লাখ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ। এই বনাঞ্চল বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই বিশাল অরণ্যাঞ্চলের গাছপালা প্রতি বছর কয়েক মিলিয়ন টন কার্বন শুষে নিয়ে বিশ্বের উষ্ণায়ন মোকাবেলা করে। কিন্তু গাছ যখন কাটা হয় অথবা পুড়িয়ে ফেলা হয় তখন যে কার্বন গাছের মধ্যে সঞ্চিত থাকে তা বায়ুমন্ডলে আবার মিশে যায় এবং উষ্ণমন্ডলীয় এসব বৃক্ষের কার্বন শুষে নেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পায়।

প্রভাব আরো যেসব দেশে

৭ দশকি ৪ বর্গ কিলোমিটার এলাকা বিস্তৃত আমাজন বেসিনের আরো বেশ কিছু দেশ এ বছরের ব্যাপক দাবানলের কবলে পড়েছে। ব্রাজিলের পর দ্বিতীয় সর্বাধিক আগুনের ঘটনা ঘটেছে ভেনিজুয়েলায়। সেখানে দাবানল হয়েছে ২৬ হাজারটি। তৃতীয় স্থানে বলিভিয়া যেখানে আগুনের ঘটনা ঘটেছে ১৭ হাজারের বেশি। বলিভিয়া সরকার দেশের পূর্বাঞ্চলে দাবানল নেভানোর কাজে সহায়তা করার জন্য একটি বিমানের মাধ্যমে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র ভাড়া করেছে। প্রায় ছয় বর্গমিটার এলাকাজুড়ে আছে বলিভিয়ার বনাঞ্চল। ওই এলাকায় পাঠানো হয়েছে অতিরিক্ত জরুরিকালীন কর্মী। আগুনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য পশুপাখিদের জন্য অভয়ারণ্য তৈরি করা হচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here