আবরার হত্যা : ক্ষোভে ফুঁসছে সারাদেশ

0
461
আবরার হত্যা : ক্ষোভে ফুঁসছে সারাদেশ

খবর৭১ঃ
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদের হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে ফুঁসে উঠেছে সারাদেশ। মঙ্গলবার দিনভর উত্তাল ছিল বুয়েট ক্যাম্পাস। সকাল ৯টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শহিদ মিনারের পাদদেশে অবস্থান নেন। পরে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে বিক্ষোভ মিছিল করেন তারা।

এদিকে আবরার হত্যার ঘটনায় শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে খুনিদের ফাঁসি, সাত দিনের মধ্যে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করাসহ ৮ দফা দাবি উত্থাপন করেন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত বুয়েটের সকল ক্লাস-পরীক্ষা ও একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করেন তারা। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, আবরার হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।

গত রবিবার রাতে বুয়েটের শের-ই-বাংলা হলের একটি কক্ষে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় মেধাবী ছাত্র আবরারকে। সম্প্রতি ফেসবুকে বাংলাদেশ-ভারত চুক্তি নিয়ে তার লেখা একটি স্ট্যাটাসের কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় এ পর্যন্ত ১৩ ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ জনকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। আবরারের বাবার দায়ের করা হত্যা মামলাটি তদন্ত করছে গোয়েন্দ পুলিশ।

এই হত্যার প্রতিবাদে বুয়েট ছাড়াও গতকাল দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস এবং জেলা ও বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ-মানববন্ধন করেছেন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। এ সময় খুনিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তারা।

দিনভর বুয়েটে বিক্ষোভ : প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বেলা সাড়ে ১০টার দিকে বিভিন্ন হল থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা বুয়েট শহিদ মিনার এলাকায় সমবেত হন। বুয়েটের সাবেক একদল শিক্ষার্থীও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি মিছিল বেলা পৌনে ১২টার দিকে বুয়েট শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেয়। পরে বুয়েট শিক্ষক সমিতির প্রতিনিধিরাও সমাবেশস্থলে এসে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন।

এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘আমার ভাই মরল কেন, প্রশাসন জবাব চাই?’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে’, ‘প্রশাসনের তালবাহানা, চলবে না চলবে না’, ‘তুমি নীরব কেন, জবাব চাই জবাব চাই জবাব চাই’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন।

শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ কে এম মাসুদ সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে কোনো শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যাবে, এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। অ্যাকাডেমিক ভবন, হলসহ সমগ্র ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। আবরার ফাহাদের হত্যার ঘটনা প্রমাণ করছে যে কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের নিরাপত্তা দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। আমরা শিক্ষার্থীদের সব দাবির সঙ্গে একমত।’

শিক্ষার্থীদের আট দাবি : আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আট দফা দাবিগুলো হলো—খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা, ৭২ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আজীবন বহিষ্কার করা, আবাসিক হলগুলোতে র্যাগিংয়ের নামে এবং ভিন্নমত দমনের নামে নির্যাতন বন্ধে প্রশাসনের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করা, ঘটনার ৩০ ঘণ্টা পরও ভিসি কেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হননি ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে জবাব দেওয়া, আবরার হত্যা মামলার খরচ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বহন করতে হবে, পূর্বের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর বিচার করা, ১১ অক্টোবরের মধ্যে শেরে-ই-বাংলা হলের প্রভোস্টকে প্রত্যাহার এবং আগামী সাত দিনের মধ্যে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতিসহ সকল সংগঠনের কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।

গেটে তালা, অবরুদ্ধ ভিসি : হলে ছাত্র হত্যার পরও উপাচার্যের দেখা না পাওয়ায় বিকালে ভিসি কার্যালয় ঘিরে বিক্ষোভ শুরু করেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা। কিন্তু কার্যালয়ের গেটের ভেতর থেকে তালা দেওয়া থাকায় সেখানে প্রবেশ করতে পারেননি শিক্ষার্থীরা। পরে গেটের বাইরে থেকে আরেকটি তালা লাগিয়ে কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন তারা। এ সময় উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করতে না পারায় গেটের তালা ভেঙে প্রবেশ করার দাবিও ওঠে। আবার একপক্ষ দাবি জানান, উপাচার্য নিজ থেকে এসে শিক্ষার্থীদের কাছে জবাবদিহি করুক। এক পর্যায়ে ভিসি অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম গেটের সামনে এসে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে আমি নীতিগতভাবে একমত। সমস্যার সমাধানে কাজ করছি। এ জন্য সময় প্রয়োজন।’ কেন তিনি এত সময় পরে ক্যাম্পাসে এলেন—সে ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাব দেননি। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে গেটের তালা খুলতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে ভিসি আর বেরুতে পারেননি। এদিকে আবরার হত্যাকাণ্ডের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির এমন নীরবতার তীব্র সমালোচনা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, সোমবার উপাচার্য তার কার্যালয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি শিক্ষকদের সঙ্গে একটি সভায়ও অংশ নেন। তবে যেখানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, সেই শেরে-ই-বাংলা হলে তিনি যাননি, এমনকি প্রকাশ্যেও দেখা যায়নি তাকে। তার প্রকাশ্যে না আসার বিষয়টি নিয়ে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ।

তোপের মুখে ছাত্রকল্যাণ পরিচালক : এর আগে সকালে বুয়েটের শহিদ মিনারে শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে তিনি ক্যাম্পাসে আসলে আন্দোলনকারীরা তাকে ঘিরে ধরেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের জন্য তার কাছে দাবি জানান। শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সন্তোষজনক জবাব না দেওয়ায় তোপের মুখে পড়েন তিনি। পরে অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমি মনে করি বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন নেই।’ এ সময় শিক্ষার্থীরা করতালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানান।

ঢাবিতে গায়েবানা জানাজা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবরার ফাহাদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল দুপুর ১২টার দিকে টিএসসি চত্বরে গায়েবানা জানাজায় কয়েক হাজার শিক্ষার্থী অংশ নেন। জানাজার পূর্বে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন শিক্ষার্থীরা। তারা এ ঘটনায় বুয়েট প্রশাসনের তীব্র সমালোচনা করে হত্যাকারীদের শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানান। আর বিচার কাজে কোনো অবহেলা লক্ষ্য করা গেলে কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দেন শিক্ষার্থীরা। তারা বলেন, আবরার দেশের পক্ষে কথা বলে শহিদ হয়েছেন। জানাজা শেষে আবরারের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here