অনুসন্ধানী মূলক প্রতিবেদন -সুন্দরগঞ্জ ছিল রক্তাত বিভীষিকাময়

0
721

আবু বক্কর সিদ্দিক, গাইবান্ধা  জেলা প্রতিনিধিঃ
২০১৭ সাল ছিল গাইবান্ধা-১ (সুন্দরগঞ্জ) আসনের পরপর নির্বাচিত ২ জন সাংসদের দাফন আর রক্তাত বিভীষিকাময় বিশ্বব্যাপী বহুল আলোচনায় ‘সুন্দরগঞ্জ’।
শুধু তাই না; সাবেক জোট ও মহাজোট সরকার আমলের সাবেক সাংসদেরকে তাদের সহোচরদেরসহ বহুল আলোচিত লোমহর্ষক ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তার ও ঐতিহাসিক রায় প্রদানে। এসব ঘটনার মূল আলোচনায় রয়েছেন- বর্তমান সরকারামলের সাংসদ- মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন ও গোলাম মোস্তফা আহম্মেদ, মহাজোট সরকারামলের (জাপা) সাবেক সাংসদ- কর্ণেল (অবঃ) ডাঃ আব্দুল কাদের খাঁন ও জোট সরকারামলের (জামায়াত) আরেক সাবেক সাংসদ- আব্দুল আজিজ ওরফে ঘোড়ামারা আজিজ।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, চলতি (২০১৭) সালের ২ জানুয়ারী এ আসনের নির্বাচিত সাংসদ ও উপজেলা আ’লীগের সভাপতি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে সর্বানন্দ ইউনিয়নের উত্তর সাহবাজ গ্রামের মাষ্টারপাড়াস্থ বাসভবনের উঠানে তাঁর মা-বাবার কবরের পাশে দাফন করা হয়। এরআগে অর্থাৎ ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নিজ ঘরে আততায়ীদের ছোঁড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুত্বর আহতাবস্থায় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীনাবস্থায় মারা যান তিনি। এ ঘটনায় নিহত সাংসদ লিটনের ছোট বোন ফাহমিদা বুলবুল কাকলী বাদী হয়ে অজ্ঞাত নামা ৪ থেকে ৫ জনের বিরুদ্ধে থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় ১’শ ৫৮ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসা বাদ করেন থানা পুলিশ। এঘটনায় নিহত সাংসদ (এমপি)- লিটনের পরিবারসহ স্বজন ও স্বদলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন প্রশাসনের নজরদারীতে। একপর্যায়ে তথ্য প্রযুক্তিগত পদ্ধতি অনুযায়ী অন্য একটি ছিনতাই ঘটনায় ফেলে যাওয়া পিস্তুলের গুলি ও ম্যাগজিনের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে গিয়ে এ (একই) আসনের মহাজোট সরকারামলের (জাপার) সাবেক সাংসদ- কর্ণেল (অবঃ) ডাঃ আব্দুল কাদের খাঁনকে পরবর্তী ২১ ফেব্রুয়ারী (২০১৭) বিকেলে বগুড়া শহরের রহমানগড় এলাকায় গরীবশাহ্ ক্লিনিক কাম বাসভবন থেকে গ্রেপ্তারের পূর্বে শামীম, মেহেদী, রানা, হান্নান ও পরে এ সাবেক সাংসদের এপিএস শামছুজ্জোহা ও কশাই সুবলকে গ্রেপ্তার করেন প্রশাসন। এ ঘটনার অপর সমন্বয়কারী চন্দন কুমার রায় পালিয়ে দেশ ত্যাগ করে গাঁ ঢাকা দিয়েছে। পরর্বতীতে চন্দন কুমার রায় ভারতে পুলিশের হাতে আটক হলেও তাকে দেশে ফিরে আনার ব্যাপারে প্রক্রিয়া চলছে বলে একাধিক সূত্র জানায়। এ ব্যাপারে সুন্দরগঞ্জ থানার তৎকালীণ নিরস্ত্র পুলিশ পরিদর্শক (ওসি-তদন্ত)- আবু হায়দার আশরাফুজ্জামান আরিফ এ হত্যা মামলাটি তদন্তকারী কর্মকর্তা (আইও) হিসেবে বিজ্ঞ আদালতে চার্জসীট প্রদান করেন। এছাড়া, গ্রেপ্তারকৃত সাবেক সাংসদ- কর্ণেল (অবঃ) আব্দুল কাদের খাঁনের বিরুদ্ধে পরবর্তী ১৮ জুলাই একটি অস্ত্র মামলার দায়ের করেন। এ মামলায় এপর্যন্ত ১১ জন সাক্ষীর স্বাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন বিজ্ঞ আদালত। আর এমপি লিটন হত্যা মামলার আসন্ন ৮ জানুয়ারী ২০১৮ ইং তারিখে ধার্য তারিখ নির্ধারণ করেছেন বিজ্ঞ আদালত। সাংসদ (এমপি) লিটনের মৃত্যুর পর ২ মাস ২১ দিন পর, অর্থাৎ ২২ মার্চ-২০১৭ ইং তারিখে অনুষ্ঠিত হয় এ আসনের উপ-নির্বাচন। এ নির্বাচনে উপজেলা আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা আহম্মেদ আ’লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ৯০ হাজার ১’শ ৫৯ ভোট পেয়ে এমপি নির্বাচিত হন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাপা মনোনীত প্রার্থী ব্যারিষ্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী পান ৬০ হাজার ১’শ ভোট। সাংসদ (এমপি) গোলাম মোস্তফা আহম্মেদ গত ১৮ নভেম্বর বিকেলে ঢাকা যাবার সময় টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার নাটিয়াপাড়া নামক স্থানে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে মর্মান্তিক সড়ক দূর্ঘটনায় আহত হন। তিনি প্রথমে টাঙ্গাইল সদর হাসপাতাল ও পরে ঢাকাস্থ এসএমএইচ (সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল)-এ দীর্ঘ ১ মাস ধরে চিকিৎসা শেষে গত ১৯ ডিসেম্বর সকাল ৮ টা ৩৫ মিনিটে মারা যান। ঐ দিনই বাদ মাগরীব উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নের চন্ডিপুর গ্রামের ফারাজীপাড়াস্থ নিজ বাস ভবনের পাশে পারিবারিক কবর স্থানে তাঁর মরদেহ দাফন সম্পন্ন করা হয়। এরআগে সাংসদ লিটনের মতই মহান জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় প্রথম যানাযা ও মরদেহে শেষ শ্রদ্ধা জানান- মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধান মন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী, এমপি ও উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ। চলতি বছরে (২০১৭) পরপর নির্বাচিত ২ জন সাংসদের ‘রক্তাত বিভীষিকাময়’ মৃত্যুতে ব্যাপক আলোচনায় আসে “সুন্দরগঞ্জ” যে, একই সরকারামলে ইতোপূর্বে দেশের এমন কোন আসেনের পর পর নির্বাচিত ২ জন সাংসদের একই বছরে রক্তাতো (রক্তপাত) মধ্যে দিয়ে জীবনের ইতি ঘটেনি। শুধু তাই নয়; একই সালে ঘটেছে মহাজোট সরকার আমলের (জাপা) আর এক সাবেক সাংসদ কর্ণেল (অবঃ) ডাঃ আব্দুল কাদের খাঁন ও তার সহচরদেরসহ লোমহর্ষক ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়ে জেল হাজতে বসবাসের বিষয়টি যেমন বিশে^ ব্যাপী ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি করেছে, তেমনি স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর গত ২২ নভেম্বর ২০১৭ইং তারিখে আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিজ্ঞ বিচারপতির দেয়া একটি মানবতা বিরোধী অপরাধে দায়েরকৃত মামলায় প্রমাণিত সংশ্লিষ্ট অপরাধি এই আসনের জোট সরকার আমল (জামায়াত)’র সাবেক সাংসদ আব্দুল আজিজ মিয়া ওরফে আবু সালেহ আব্দুল আজিজ ওরফে ঘোড়ামারা আজিজ ও তার দোসর রুহুল আমিন ওরফে মঞ্জু, আব্দুল লতিফ, আবু মসলিম মোহাম্মদ আলী, নাজমুল হুদা ও আঃ রহিম মিয়ার বিরুদ্ধে মৃত্যু দ-াদেশ । জোট সরকারামলে সাবেক সাংসদ জামায়াত নেতা আব্দুল আজিজ ওরফে ঘোড়ামারা আজিজ ও অন্যান্যরা পলাতক থাকলেও সাজাপ্রাপ্ত আব্দুল লতিফ কারাগারেই রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালে ঘোড়ামারা আজিজ পাকহানাদার বাহিনীর হয়ে তার দোসরদেরসহ নির্যাতন, গুম, হত্যা, লন্ঠনের মতো লোমহর্ষক ঘটনায় যেমন বাংলার ইতিহাসে লিপিবদ্ধ রয়েছে, তেমনি বিজ্ঞ ট্রাইব্যুনালের ঐতিহাসিক রায় প্রদানসহ ২০১৭ সালের প্রবাহমান ঘটনার মধ্যে বিশ^ব্যাপী আলোচনায় এসেছে- “রক্তাত সুন্দরগঞ্জ”।
এমপি লিটন হত্যা মামলা বাদী ও নিহতের ছোট বোন ফাহমিদা বুলবুল কাকলী বলেন, দেরীতে হলেও যেন মামলার রায় সুষ্ঠু হয়। কোন অপরাধী যেন পার না পায়। আবার ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা নেই, এমন কেউ হয়রানীর স্বীকার না হয়। এটাই আশা করি।
নিহত এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের স্ত্রী সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতি ন্যায় বিচারের দাবী জানিয়ে বলেন, দ্রুত অপরাধীদের শাস্তি কামনা করি।
এমপি লিটন হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও সাবেক সাংসদ কর্ণেল (অবঃ) আব্দুল কাদের খাঁনের বিরুদ্ধে অস্ত্র মামলার বাদী সুন্দরগঞ্জ থানার তৎকালীন নিরস্ত্র পুলিশ পরিদর্শক (ওসি-তদন্ত) আবু হায়দার আশরাফুজ্জামান আরিফ পদোন্নতি পেয়ে বর্তমানে কুড়িগ্রাম জেলায় রয়েছেন। তাঁর স্থালাভিশিক্ত নিরস্ত্র পুলিশ পরিদর্শক (ওসি-তদন্ত)- ওমর ফারুক ও থানা অফিসার ইনচার্জ- আতিয়ার রহমানের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে কথা হলে তাঁরা বলেন, এমপি লিটন হত্যা ও অস্ত্র আইনের মামলায় সাবেক সাংসদ কর্ণেল (অবঃ) আব্দুল কাদের খাঁনসহ তার সহচররা কারাগারে রয়েছে। তবে এমপি লিটন হত্যাকান্ডে অপর সমন্বয়কারী চন্দন কুমার রায়কে গ্রেপ্তার পূর্বক ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরে আনার জন্য বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে ভারত পুলিশের নিকট আবেদন করা হয়েছে।
গাইবান্ধা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি)- শফিকুল ইসলাম (শফিক)- বলেন আগামী ৮ জানুয়ারী এমপি লিটন হত্যা মামলাটি সেশন মামলায় অর্ন্তভূক্ত হবে। এ মামলার অন্যতম আসামী চন্দন কুমার রায়কে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। আর অস্ত্র আইনের মামলায় এপর্যন্ত ১১ জনের স্বাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন বিজ্ঞ আদালত।

খবর ৭১/ এস:

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here